নিশানাথবাবুর স্ত্রী!
প্ৰস্তুত ছিলাম না। স্বভাবতাই ধারণা জন্মিয়ছিল নিশানাথবাবুর স্ত্রী বয়স্থ মহিলা; দ্বিতীয় পক্ষের কথা একেবারেই মনে আসে নাই। আমাদের মুখের বোকাটে বিস্ময় বোধ করি অসভ্যতাই প্ৰকাশ করিল। তারপর আমরা নমস্কার করিলাম। দময়ন্তী দেবী সরবতের ট্রে টেবিলে নামাইয়া রাখিয়া বুকের কাছে দুই হাত যুক্ত করিয়া প্রতিনমস্কার করিলেন। নিশানাথ বলিলেন,–’এঁরা আজ এখানেই খাওয়া-দাওয়া করবেন।’
দময়ন্তী দেবী একটু হাসিয়া ঘাড় বুকাইলেন, তারপর ধীরপদে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
আমরা আবার উপবেশন করিলাম। নিশানাথ আমাদের হাতে সরবতের গেলাস দিয়া কথাচ্ছিলে বলিলেন,–’এখানে চাকর-বাকির নেই, নিজেদের কাজ আমরা নিজেরাই করি।’
ব্যোমকেশ ঈষৎ উৎকণ্ঠিত স্বরে বলিল,–’সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আমরা এসে মিসেস সেনের কাজ বাড়িয়ে দিলাম না তো? আমাদের জন্যে আবার নতুন করে রান্নাবান্না-’
নিশানাথ বলিলেন,–’আপনাদের আসার খবর আগেই দিয়েছি, কোনও অসুবিধা হবে না। মুকুল বলে একটি মেয়ে আছে, রান্নার ভার তারই; আমার স্ত্রী সাহায্য করেন। এখানে আলাদা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই; একটা রান্নাঘর আছে, সকলের রান্না একসঙ্গে হয়।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’আপনার এখানকার ব্যবস্থা দেখে সত্যিকার আশ্রম বলে মনে হয়।’
নিশানাথবাবু কেবল একটু অম্লরসাক্ত হাসিলেন। ব্যোমকেশ সরবতে চুমুক দিয়া বলিল,–’বাঃ, চমৎকার ঠাণ্ড সরবৎ, কিন্তু বরফ দেওয়া নয়। ফ্রিজিডেয়ার আছে!’
নিশানাথ বলিলেন,–’তা আছে। —এবার মোটরের টুকরোগুলো আপনাকে দেখাই। ফ্রিজিডেয়ারের অস্তিত্ব যেমন চট্ট করে বলে দিলেন আমার অজ্ঞাত উপহারদাতার নামটাও তেমনি বলে দিন তবে বুঝব।’
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া বলিল,–’নিশানাথবাবু্, পৃথিবীর সব রহস্য যদি আপনার ফ্রিজিডেয়ারের মত স্বয়ংসিদ্ধ হত তাহলে আমার মত যারা বুদ্ধিজীবী তাদের অন্ন জুটত না।–ভাল কথা, কাল আপনি আমাকে পঞ্চাশ টাকা না দিয়ে ষাট টাকা দিয়ে এসেছিলেন।’
নিশানাথবাবু একটু অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন,–’তাই নাকি? ভাগ্যে কম টাকা দিইনি। তা ও টাকা আপনার কাছেই থাক, পরে না হয় হিসেব দেবেন।’
হিসাব দেওয়া কিন্তু ঘটিয়া ওঠে নাই।
নিশানাথ রোল টপ টেবিল খুলিয়া কয়েকটা মোটরের ভাঙা টুকরা আমাদের সম্মুখে রাখিলেন। স্পার্কিং প্লাগ, ছেড়া রবারের মোটর-হর্নি্্, টিনের লাল রঙ-করা খেলনা মোটর, সবই রহিয়াছে; ব্যোমকেশ সেগুলিকে দেখিল, কিন্তু বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। কেবল খেলনা মোটরটিকে সন্তৰ্পণে ধরিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নিরীক্ষণ করিল। বলিল,–’এতে কারুর আঙুলের টিপ দেখছি না, একেবারে ঝাড়া মোছা।’
নিশানাথ বলিলেন,–’আঙুলের ছাপ আমিও খুঁজেছিলাম। কিন্তু কিছু পাইনি। আমার উপহারদাতা খুব সাবধানী লোক।’
ব্যোমকেশ বলিল,–’আিৰ্হ। মোটরের টুকরোগুলো অবশ্য দাতা মহাশয় পাশের মোটর-ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করেছেন। এ থেকে একটা কথা আন্দাজ করা যায়।’
‘কী আন্দাজ করা যায়?’
‘দাতা মহাশয় কাছেপিঠের লোক। এখানে আশেপাশে কোনও বসতি আছে নাকি?’
‘না। মাইলখানেক আরও এগিয়ে গেলে মোহনপুর গ্রাম পাওয়া যায়। আমার মালীরা সেখান থেকেই কাজ করতে আসে।’
‘মোহনপুরে ভদ্রশ্রেণীর কেউ থাকে?’
‘দু এক ঘর থাকতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগই চাষাভুষো! তাদের কাউকে আমি চিনিও না। অবশ্য মালীদের ছাড়া।’
‘সুতরাং সেদিক থেকে উপহার পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই, কারণ যিনি উপহার পাঠাচ্ছেন তিনি ভদ্রশ্রেণীর লোক। চলুন। এবার আপনারা, কলোনী পরিদর্শন করা যাক।’
কলোনী পরিদর্শনের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে কলোনীর মানুষগুলিকে, বিশেষ নারীগুলিকে চক্ষুষ করা, একথা আমরা সকলে মনে মনে জানিলেও মুখে কেহই তাহা প্রকাশ করিল না। নিশানাথবাবু আমাদের জন্য তিনটি ছাতা সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছিলেন, আমরা ছাতা মাথায় দিয়া বাহির হইলাম। তিনি নিজে একটি সোলা-হ্যাটু পরিয়া লইলেন। কালো কাচের চশমা তাঁহার চোখেই ছিল।
এইখানে, উদ্যান পরিক্রম আরম্ভ করিবার আগে, গোলাপ কলোনীর একটি নক্সা পাঠকদের সম্মুখে স্থাপন করিতে চাই। নক্সা থাকিলে দীর্ঘ বর্ণনার প্রয়োজন হইবে না। —
১। নিশানাথ গৃহ; ২। বিজয়ের ঘর; ৩। বনলক্ষ্মীর ঘর; ৪। ভুজঙ্গাধরের ঘর ও ঔষধালয়; ৫। ব্ৰজদাসের ঘর; ৬। রসিকের ঘর; ৭। কৃপা; ৮। আস্তাবল ও মুস্কিলের ঘর; ৯। গোশালা ও পানুর ঘর; ১০। মুকুল ও নেপালের ঘর; ১১। ভোজনকক্ষ ও পাকশালা; ১২। অব্যবহৃত হাঁটু-হাউস; ১৩। সামরিক মোটরের সমাধিক্ষেত্ৰ।
বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আমরা বাঁ দিকের পথ ধরিলাম। সুরকি-ঢাকা পথ সঙ্কীর্ণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন, আকিয়া বাঁকিয়া কলোনীর সমস্ত গৃহগুলিকে সংযুক্ত করিয়া রাখিয়াছে।
প্রথমেই পড়িল ফটকের পাশে লম্বা টানা একটা ঘর। মাথার উপর টালির ফাঁকে ফাঁকে কাচ বসানো, দেওয়ালেও বড় বড় কাচের জানালা! কিন্তু ঘরটি অনাদৃত, কাচগুলি অধিকাংশই ভাঙিয়া গিয়াছে; অন্ধের চক্ষুর মত ভাঙা ফোকরের ভিতর দিয়া কেবল অন্ধকার দেখা যায়।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল,–’এটা কি?’
নিশানাথ বলিলেন,–’হট্-হাউস করেছিলাম, এখন পড়ে আছে। বেশি শীত বা গরম পড়লে কচি চারাগাছ এনে রাখা হয়।’