কথায়বাতায় রাত্রি সাড়ে আটটা বাজিয়া গেল। অতঃপর অন্দর হইতে আহারের ডাক আসিল। এই সময় অনাদি সরকারকে দেখিলাম; সে আমাদের ডাকিতে আসিয়াছিল। লোকটির বয়স বছর পঞ্চাশ হইবে; অত্যন্ত শীর্ণ কোলকুঁজা চেহারা। গালের মাংস চুপসিয়া অভ্যস্তরের কোন অতল গহ্বরে অদৃশ্য হইয়া গিয়াছে, ঝাঁকড়া গোঁফ ওষ্ঠাধর লিঙঘন করিয়া চিবুকের কাছে আসিয়া পড়িয়ছে। চোখে একটা অস্বচ্ছন্দ উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি-যেন কোনাে দারুণ দুস্কৃতি করিয়া ধরা পড়িবার ভয়ে সর্বদা সশঙ্ক হইয়া আছে।
ব্যোমকেশ তাহাকে একবার তীক্ষ্মদৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখিয়া লইল। তারপর আমরা তিনজনে তাহাকে অনুসরণ করিয়া অন্দর মহলে প্রবেশ করিলাম।
আহারাদির পর একজন ভৃত্য আমাদের পথ দেখাইয়া শয়নকক্ষে লইয়া গেল। ভূত্যটির নাম ভুবন-সেই হিমাংশুবাবুর খাস বেয়ারা। শয়নকক্ষে ইজিচেয়ারে বসিয়া আমরা সিগারেট ধরাইলাম; ভুবন মশারি ফেলিয়া, জলের কুঁজা হাতের কাছে রাখিয়া, ঘরের এটা ওটা ঝাড়িয়া ঝাড়ন স্কন্ধে প্রস্থান করিতেছিল, ব্যোমকেশ তাহাকে ডাকিয়া বলিল, ‘তুমি তো হরিনাথ মাস্টারকে ছমাস ধরে দেখেছ, সে কি সব সময় চশমা পরে থাকত?’
আমরা যে চুরির তদন্তু করিতে আসিয়াছি তাহা ভুবন বোধকরি জানিত, তাই কথা কহিবার সুযোগ পাইয়া সে উৎসুকভাবে বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, চব্বিশ ঘণ্টাই তো চশমা পরে থাকতেন। একদিন চশমা না পরে স্নান করতে যাচ্ছিলেন, হোঁচটি খেয়ে পড়ে গেলেন। বিনা চশমায় তিনি এক-পা চলতে পারতেন না বাবু।‘
ব্যোমকেশ বলিল, “হুঁ। আচ্ছা, তার জুতো ক’জোড়া ছিল বলতে পার?’
ভুবন হাসিয়া বলিল, “জুতো আবার ক’জোড়া থাকবে বাবু, এক জোড়া। তাও সরকার থেকে কিনিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে-জোড়া পরে তিনি এসেছিলেন সে তো এমন ছেড়া যে কুকুরেও খায় না। আমরা সেই দিনই জুতো টান মেরে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়েছিলুম।‘
‘বটে! আচ্ছা, মাস্টারের ঘরের দেয়ালে যে একটি মা কালীর ছবি টাঙানো রয়েছে সেটা কি মাস্টার সঙ্গে করে এনেছিল?”
‘আজ্ঞে না হুজুর, মাস্টারবাবু একটি খড়কে কাঠিও সঙ্গে করে আনেননি। ও ছবি দেওয়ানজীর কাছ থেকে মাস্টারবাবু একদিন এনে নিজের ঘরে টাঙিয়েছিলেন।‘
‘বুঝেছি।‘ ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, “আচ্ছা, তুমি এখন যেতে পার।
ভুবন জিজ্ঞাসা করিল, ‘আর কিছু চাই না হুজুর?’
‘না। ভাল কথা, একটা কাজ করতে পার? বাড়িতে পাঁজি আছে নিশ্চয়, একবার আনতে পার?’
ভুবন বোধকরি মনে মনে একটু বিস্মিত হইল। কিন্তু সে জমিদার বাড়ির লেফাফাদুরস্ত চাকর, সে ভাব প্রকাশ না করিয়া বলিল, ‘এখনি কি চাই হুজুর?
‘এখনি হলে ভাল হয়।‘
‘যে আজ্ঞে–এনে দিচ্ছি।‘
ভুবন বাহির হইয়া গেল। আমরা নীরবে ধূমপান করিতে লাগিলাম। পাঁচ মিনিট কাটিয়া গেল।
তারপর, হঠাৎ অতি সন্নিকটে একটানা বিকট একটা আর্তনাদ শুনিয়া আমরা ধড়মড় করিয়া সোজা হইয়া বসিলাম। কিন্তু তখনি বুঝিলাম, অনৈসৰ্গিক কিছু নয়-শেয়াল ডাকিতেছে। পাঁচ-ছয়টা শৃগাল একত্র হইয়া নিকটেরই কোনো স্থান হইতে সম্মিলিত উর্ধর্বস্বরে যাম ঘোষণা করিতেছে। এত নিকট হইতে শব্দটা আসিল বলিয়া হঠাৎ চমকিয়া উঠিয়াছিলাম।
এই সময় ভুবন পাঁজি হাতে ফিরিয়া আসিল। আমি বলিয়া উঠিলাম, ‘ও কি হে! বাড়ির এত কাছে শেয়াল ডাকছে?’
শেয়ালের ডাক তখন থামিয়াছে, ভুবন হাসি চাপিয়া বলিল, ‘আসল শেয়াল নয় হুজুর। বেবিদিদি আজ সন্ধ্যে থেকে বায়না ধরেছিলেন দেওয়ান ঠাকুরের কাছে শেয়াল ডাক শুনবেন। তাই তিনিই ডাকছেন।’
আমি বলিলাম, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যেবেলা বেবি বলছিল বটে। কিন্তু আশ্চর্য ক্ষমতা তো দেওয়ানজীর! একেবারে অবিকল শেয়ালের ডাক, কিছু বোঝবার জো নেই।’
ভুবন বলিল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। দেওয়ান ঠাকুর চমৎকার জন্তু-জানোয়ারের ডাক ডাকতে পারেন।‘ বলিয়া পাঁজি ব্যোমকেশের পাশে টেবিলের উপর রাখিল।
ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম, সে যেন হঠাৎ পাথরের মূর্তিতে পরিণত হইয়া গিয়াছে; চোখের দৃষ্টি স্থির, সর্বাঙ্গের পেশী টান হইয়া শক্ত হইয়া আছে। আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, ‘কি হে?’
ব্যোমকেশের চমক ভাঙিল। চোখের সম্মুখ দিয়া হাতটা একবার চালাইয়া বলিল, ‘কিছু না।–এই যে পাঁজি এনেছ? বেশ, তুমি এখন যেতে পারো।’
ভুবন প্রস্থান করিল। ব্যোমকেশ পাঁজিটা তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উল্টাইতে লাগিল। খানিক পরে একটা পাতায় আসিয়া তাহার দৃষ্টি রুদ্ধ হইল। সেই পাতাটা পড়িয়া সে পাঁজি আমার দিকে অগ্রসর করিয়া দিয়া বলিল, ‘এই দ্যাখা।’
মনে হইল, তাহার গলার স্বর উত্তেজনায় ঈষৎ কাঁপিয়া গেল। পাঁজির নির্দিষ্ট পাতাটা পড়িলাম। দেখিলাম, যে-রাত্রে মাস্টার নিরুদ্দেশ হইয়া যায় সে-রাত্রিটা ছিল অমাবস্যা।
৩
পরদিন সকাল সাতটার সময় গাত্ৰোখান করিয়া, প্ৰাতঃকৃত্য সমাপন্যান্তে বাহিরে আসিয়া দেখিলাম–তখনো সমস্ত বাড়িটা সুপ্ত। একজন ভৃত্য বারান্দা ঝাঁট দিতেছিল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানা গেল যে শীতকালে বেলা আটটা সাড়ে আটটার পূর্বে কেহ শয্যা ত্যাগ করে না। ইহাই এ বাড়ির রেওয়াজ।
এই দেড় ঘণ্টা সময় কি করিয়া কাটানো যায়? আকাশে একটু কুয়াশার আভাস ছিল; সূর্যের আলো ভাল করিয়া ফুটে নাই। আমার মন উসখুসি করিয়া উঠিল, বলিলাম, চল ব্যোমকেশ, এখন তো তোমার কোনো কাজ হবে না; জঙ্গলে গিয়ে দু’চারটে পাখি মারা যাক। তারপর এদের ঘুম ভাঙতে ভাঙতে ফিরে আসা যাবে।’