চোরাবালি

প্রথম বন্দুক চালাইতে শিখিয়া আগ্রহের মাত্রা কিছু বেশি হইয়াছিল‌, মনে হইতেছিল যাহা পাই তাহারই দিকে লক্ষ্য করিয়া বন্দুক ষ্টুড়িয়া দিই। বিশেষত কাল বন্দুক দুটা কুমার বাহাদুর এখানেই রাখিয়া গিয়াছিলেন‌, টোটাও কোটের পকেটে কয়েকটা অবশিষ্ট ছিল।

ব্যোমকেশ ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘চল।’

বন্দুক কাঁধে করিয়া বাহির হইলাম। যে চাকরিটা ঝাঁট দিতেছিল তাহাকে প্রশ্ন করায় সে জঙ্গলের যাইবার রাস্তা দেখাইয়া দিল; বলিল‌, এই পথে সিধা। যাইলে বালির পাশ দিয়া জঙ্গলে প্রবেশ করিতে পারিব। আমরা সবুজ ঘাসে ভরা চারণভূমির উপর দিয়া চলিলাম।

কুয়াশার জন্য ঘাসে শিশির পড়ে নাই‌, জুতা ভিজিল না। চলিতে চলিতে দেখিলাম‌, সম্মুখে এক মাইল দূরে বনের গাছগুলি গাঢ় বর্ণে আঁকা রহিয়াছে‌, তাহার কোলের কাছে বালু-বেলা অর্ধচন্দ্ৰাকারে পড়িয়া আছে-দূর হইতে অস্পষ্ট আলোকে দেখিয়া মনে হয় যেন একটা লম্বা খাল জঙ্গলের পদমূল বেষ্টন করিয়া পড়িয়া আছে। আমরা যেদিকে চলিয়াছিলাম। সেইদিকে উহার দক্ষিণ প্রান্তটা ক্রমশ সঙ্কুচিত হইয়া একটা অনুচ্চ পাড়ের কাছে আসিয়া শেষ হইয়া গিয়াছে; অতঃপর দক্ষিণ দিকে আর বালি নাই।

মিনিট পনেরো হাঁটবার পর পূর্বোক্তি পাড়ের কাছে আসিয়া পৌঁছিলাম; দেখিলাম পাড় একটা নয়—দুইটা। কোনো কালে হয়তো বালুর দক্ষিণ দিকে জলরোধ করিবার জন্য একটা উচু মাটির বাঁধ দেওয়া হইয়াছিল–বর্তমানে সেটা দ্বিধা ভিন্ন হইয়া গিয়াছে। মাঝখানে আন্দাজ পনেরো হাত চওড়া একটা প্ৰণালী একদিকের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠের সহিত অপর দিকের বালুর চড়ার সংযোগ স্থাপন করিয়াছে।

আমরা নিকটতর টিবিটার উপর উঠিলাম। সম্মুখে নীচের দিকে চাহিয়া দেখিলাম গঙ্গা-যমুনা সঙ্গমের মত একটা ক্ষীণ রেখা ঘাসের সীমানা নির্দেশ করিয়া দিতেছে-তাহার পরেই অনিশ্চিত ভয়সস্কুল বালুর এলাকা আরম্ভ হইয়াছে। ইহার মধ্যে ঠিক কোনখানটায়। সেই ভয়ানক চোরাবালি কে বলিতে পারে?

বাঁধের উপর উঠিয়া যে বস্তুটি প্রথমে চোখে পড়িয়াছিল তাহার কথা এখনো বলি নাই। সেটি একটি অতি জীর্ণ কুঁড়ে ঘর। বাঁধের ভাঙ্গনের দক্ষিণ মুখটি আগুলিয়া এই কুটীর পড়ি পড়ি হইয়া কোনো মতে দাঁড়াইয়া আছে—উচ্চতা এত কম যে পাড়ের আড়াল হইতে তাহার। মটকা দেখা যায় না। ছিটা বেড়ার দেওয়াল‌, মাটি লেপিয়া জলবৃষ্টি নিবারণের চেষ্টা হইয়াছিল; এখন প্রায় সর্বত্র মাটি খসিয়া গিয়া জীর্ণ উই-ধরা হাড়-পাঁজর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। উপরের দু’চালা খড়ের চালটিও প্রায় উলঙ্গ-খড় পচিয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে‌, কোথায়ও বা গলিত অবস্থায় বুলিতেছে। বোধকরি চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ইহাতে কেহ বাস করে নাই।

বনের ধারে লোকালয় হইতে বহু দূরে এইরূপ নিঃসঙ্গ একটি কুটীর দেখিয়া আমাদের ভারি বিস্ময় বোধ হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তই তো! চল‌, ঘরটা দেখা যাক।’

আমরা ফিরিয়া বাঁধ হইতে নামিবার উপক্ৰম করিতেছি। এমন সময় আকাশে শই শই শব্দ শুনিয়া চোখ তুলিয়া দেখি একঝাঁক বন-পায়রা মাথার উপর দিয়া উড়িয়া যাইতেছে। ব্যোমকেশ ক্ষিপ্ৰহস্তে বন্দুকে টোটা ভরিয়া ফায়ার করিল। আমার একটু দেরি হইয়া গেল‌, যখন বন্দুক তুলিলাম তখন পায়রার ঝাঁক পাল্লার বাহিরে চলিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশের আওয়াজে একটা পায়রা নিম্নে বালুর উপর পড়িয়ছিল। সেটাকে উদ্ধার করিবার জন্য সম্মুখ দিয়া নামিতে গিয়া দেখিলাম সে-পথে নামা নিরাপদ নয়–পথ এত বেশি ঢালু যে পা হড়্‌কাইয়া পড়িয়া যাইবার সম্ভাবনা। ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘এত তাড়াতাড়ি কিসের হে! মরা পাখি তো আর উড়ে পালাবে না। চল‌, ঐ দিক দিয়ে ঘুরে যাওয়া যাক–কুঁড়ে ঘরটাও দেখা হবে।’

তখন যে পথে উঠিয়ছিলাম। সেই পথে নামিয়া বাঁধের ভাঙ্গনের মুখে উপস্থিত হইলাম। কুটীরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম‌, তাহাতে সম্মুখে ও পশ্চাতে দুইটি দ্বার আছে‌, যেটা দিয়া প্রবেশ করিলাম তাহার কবাট নাই‌, কিন্তু যেটা বালুর দিকে সেটাতে এখনো একটা বাখ্যারির আগাল লাগিয়া আছে।

ঘরের মধ্যে মনুষ্যের ব্যবহারের উপযোগী কিছুই নাই। মেঝে বোধহয় পূর্বে গোময়লিপ্ত ছিল‌, এখন তাহার উপর ঘাস গজাইয়াছে-পচা খড় চাল হইতে পড়িয়া স্থানটাকে আকীর্ণ করিয়া রাখিয়াছে। ঘরটি চওড়ায় ছয় হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু দৈর্ঘ্যে দুই বাঁধের মধ্যবর্তী স্থানটা সমস্ত জুড়িয়া আছে। এদিক হইতে বালুর দিকে যাইতে হইলে ঘরের ভিতর দিয়া যাইতে হয়; অন্য পথ নাই।

ব্যোমকেশ ঘরের অপরিষ্কার মেঝে ভাল করিয়া পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘সম্প্রতি এ ঘরে কোনো মানুষ এসেছে। এখানে খড়গুলো চেপে গেছে।–দেখেছ? ঐ কোণে কিছু একটা টেনে সরিয়েছে। এ ঘরে মানুষের যাতায়াত আছে।’

মানুষের যাতায়াত থাকা কিছু বিচিত্র নয়। রাখাল বালকেরা এদিকে গরু চরাইতে আসে‌, হয়তো এই ঘরের মধ্যে খেলা করিয়া তাহারা দ্বিপ্রহর যাপন করে। ‘তা হবে বলিয়া আমি অন্য দ্বারের আগল খুলিয়া বালির দিকে বাহির হইলাম। মনটা পাখির দিকেই পড়িয়া ছিল।

কিন্তু পাখি কোথায়? পাখিটা সম্মুখেই পড়িয়াছিল‌, লক্ষ্য করিয়াছিলাম; অথচ কোথাও তাহার চিহ্নমাত্র বিদ্যমান নাই। আমি আশ্চর্য হইয়া ব্যোমকেশকে ডাকিয়া বলিলাম‌, ‘ওহে‌, তোমার পাখি কৈ? সত্যিই কি মরা পাখি উড়ে গেল নাকি?’

ব্যোমকেশ বাহির হইয়া আসিল। সেও চারিদিকে চক্ষু ফিরাইল‌, কিন্তু পাখির একটা পালকও কোথাও দেখা গেল না। ব্যোমকেশ আস্তে আস্তে বলিল‌, ‘তই তো।’

0 Shares