‘একটু এগিয়ে দেখা যাক, হয়তো আশেপাশে কোথাও আছে।’ বলিয়া আমি বালুর উপর প্রশ্ন করতে যাইব ব্যোকেশের একটা হাত বিদ্যুদ্বেগে আসিয়া আমার কোটের কলার চাপিয়া ধরিল।
‘থামো—‘
‘কি হল?’ আমি অবাক হইয়া তাহার মুখের পানে তাকাইলাম।
‘বালির ওপর পা বাড়িও না।’
সদ্য-ছোঁড়া কার্তুজের শূন্য খোলটা বোমকেশ পকেটেই রাখিয়াছিল, এখন সেটা বাহির করিল। সম্মুখদিকে প্রায় বিশ হাত দূরে বালুর উপর ছুঁড়িয়া দিয়া বলিল, ‘ভাল করে লক্ষ্য কর।’ চাপা উত্তেজনায় তাহার স্বর প্রায় রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।
লাল রঙের খোলটা পরিষ্কার দেখা যাইতেছিল, সেইদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকাইয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে আমার মাথার চুল খাড়া হইয়া উঠিল। কি সর্বনাশ!
কার্তুজ খোলের ভারী দিকটা নামিয়া গিয়া সেটা খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল, তারপর নিঃশব্দে বালুর মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেল।
এই চোরাবালি! এবং ইহাতেই আমি গবেটের মত এখনি পদার্পণ করিতে যাইতেছিলাম। ব্যোমকেশ বাধা না দিলে আজ আমার কি হইত ভাবিয়া শরীরের রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া গেল।
ব্যোমকেশের চোখ দুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছিল, তাহার ওষ্ঠাধর বিভক্ত হইয়া দাঁতগুলা ক্ষণকালের জন্য দেখা গেল। সে বলিল, ‘দেখলে! উঃ, কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!’
আমি কম্পিতস্বরে বলিলাম, ‘ব্যোমকেশ, তুমি আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’
আমার কথা যেন শুনিতেই পায় নাই এমনিভাবে সে কেবল অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিল, ‘কি ভয়ানক! কি ভয়ানক!’ দেখিলাম, তাহার মুখের রং ফ্যাকাসে হইয়া গেলেও চোখের দৃষ্টি ও চোয়ালের হাড় কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।
অতঃপর ব্যোমকেশ কুটীরের চাল হইতে কয়েক টুকরা বাখ্যারি ভাঙিয়া আনিল, একটি একটি করিয়া সেগুলি বালুর উপর নিক্ষেপ করিতে লাগিল। দেখা গেল, ঘাসের সীমানার প্রায় দশ হাত দূর হইতে চোরাবালি আরম্ভ হইয়াছে। কোথায় গিয়া শেষ হইয়াছে তাহা জানা গেল না, কারণ যতদূর পর্যন্ত বাখ্যারি ফেলা হইল সব বাখ্যারিই ডুবিয়া গেল। পুরাতন বাঁধের অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি বাহুবেষ্টন এই চোরাবালিকেই ঘিরিয়া রাখিয়াছে। অতীত যুগের কোনো সদাশয় জমিদার হয়তো প্রজাদের জীবন রক্ষার্থেই এই বাঁধ করাইয়াছিলেন, তারপর কালক্রমে বাঁধও ভাঙিয়া গিয়াছে, তাহার উদ্দেশ্যও লোকে ভুলিয়া গিয়াছে।
চোরাবালির পরিধি নির্ণয় যথাসম্ভব শেষ করিয়া আমরা আবার কুটীরের ভিতর দিয়া বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘অজিত, আমরা চোরাবালির সন্ধান পেয়েছি, একথা যেন ঘূণাক্ষরে কেউ জানতে না পারে। বুঝলে?’
আমি ঘাড় নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তখন কুটীরের সম্মুখে কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “বাঃ! ঘরটি কি চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে দেখেছ? পিছনে পনের হাত দুরে চোরাবালি্্, সামনে বিশ হাত দূরে গভীর বন-দু’ধারে বাঁধ। কে এটি তৈরি করেছিল জানতে ইচ্ছে করে।’
কুয়াশা কটিয়া গিয়া বেশ রৌদ্র উঠিয়ছিল। আমি বনের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, গাছের ছায়ার নীচে দিয়া একজন হাফ-প্যান্ট পরিহিত লোক, কাঁধে বন্দুক লইয়া দীর্ঘ পদক্ষেপে আমাদের দিকে আসিতেছে। গাছের ছায়ার বাহিরে আসিলে দেখিলাম, হিমাংশুবাবু।
হিমাংশুবাবু দূর হইতে হাঁকিয়া বলিলেন, ‘আপনারা কোথায় ছিলেন? আমি জঙ্গলের মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
ব্যোমকেশ মৃদুকণ্ঠে বলিল, ‘অজিত, মনে থাকে যেন–চোরাবালি সম্বন্ধে কোনো কথা নয়।’ তারপর গলা চড়াইয়া বলিল, ‘আজতের পাল্লায় পড়ে পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়েছিলুম। পাখিরা অবশ্য বেশ অক্ষত শরীরে আছে, কিন্তু আর্মস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে অজিত যেরকম অভিযান আরম্ভ করেছে, শীগগির পুলিসের হাতে পড়বে।’
আমি বলিলাম, ‘এবার কলকাতায় গিয়েই একটা বন্দুকের লাইসেন্স কিনব।’
হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বন্দুক নামাইয়া বলিলেন, ‘তারপর, কিছু পেলেন?’
‘কিছু না। আপনি একেবারে রাইফেল নিয়ে বেরিয়েছেন যে!’ বলিয়া ব্যোমকেশ তাঁহার অস্ত্রটির দিকে তাকাইল।
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ–সকালে উঠেই শুনলুম জঙ্গলে নাকি বাঘের ডাক শোনা গেছে। তাই তাড়াতাড়ি রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম; চাকরটা বললে আপনারা এদিকে এসেছেন–একটু ভাবনা হল। কারণ, হঠাৎ যদি বাঘের মুখে পড়েন তাহলে আপনাদের পাখিমারা বন্দুক আর দশ নম্বরের ছররা কোনো কাজেই লাগবে না।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাঘ এসেছে কার মুখে শুনলেন?’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘ঠিক যে এসেছেই একথা জোর করে কেউ বলতে পারছে না। আমার গয়লাটা বলছিল যে গরুগুলো সমস্ত রাত খোঁয়াড়ে ছটফট করেছে, তাই তার আন্দাজ যে হয়তো তারা বাঘের গন্ধ পেয়েছে। তা ছাড়া, দেওয়ানজী বলছিলেন। তিনি নাকি অনেক রাত্রে বাঘের ডাকের মত একটা আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। যা হোক, চলুন এবার ফেরা যাক। এখনো চা খাওয়া হয়নি।’
হাতের ঘড়ি দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাড়ে আটটা। চলুন। আচ্ছা, এই পোড়ো ঘরটা এরকম নির্জন স্থানে কে এই ঘর তৈরি করেছিল? কেনই বা করেছিল? কিছু জানেন কি?’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘জানি বৈকি। চলুন, যেতে যেতে বলছি।’
তিনজনে বাড়ির দিকে অগ্রসর হইলাম। হিমাংশুবাবু চলিতে চলিতে বলিলেন, ‘বছর চার-পাঁচ আগে-ঠিক ক’বছর হল বলতে পারছি না, তবে বাবা মারা যাবার পর-হঠাৎ একদিন আমার বাড়িতে এক বিরাট তান্ত্রিক সন্ন্যাসী এসে হাজির হলেন। ভয়ঙ্কর চেহারা, মাথায় জটার মত চুল, অজস্ৰ গোঁফদাড়ি, পাঁচ হাত লম্বা এক জোয়ান। পরনে স্রেফ একটি নেংটি্্, চোখ দুটো লাল টকটক করছে—আমার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ‘তুইতোকারি করে বললেন যে তিনি কিছুদিন আমার আশ্রয়ে থেকে সাধনা করতে চান।