ব্যোমকেশ যখন ফিরিল তখন সন্ধ্যা হয়-হয়। কুমার গাড়ি হইতে নামিলেন না; ব্যোমকেশকে নামাইয়া দিয়া শরীরটা তেমন ভাল ঠেকিতেছে না বলিয়া চলিয়া গেলেন।
তখন ব্যোমকেশের অনারে আর একবার চা আসিল। চা পান করিতে করিতে কথাবাত আরম্ভ হইল। দেওয়ানজীও আসিয়া বসিলেন। ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হল?’
ব্যোমকেশ চায়ে চুমুক দিয়া বলিল, ‘বিশেষ কিছু হল না। পুলিসের ধারণা হরিনাথ মাস্টারকে প্রজারা কেউ নিজের বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছে।’
দেওয়ানজী বলিলেন, ‘আপনার তা মনে হয় না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না। আমার ধারণা অন্যরকম।’
‘আপনার ধারণা হরিনাথ বেঁচে নেই?’
ব্যোমকেশ একটু বিস্মিতভাবে বলিল, ‘আপনি ‘কি করে বুঝলেন? ও, অজিত বলেছে। হঁহা-আমার তাই ধারণা বটে। তবে আমি ভুলও করে থাকতে পারি।’
কিছুক্ষণ কোনো কথা হইল না। আমি অত্যন্ত অস্বস্তি অনুভব করিতে লাগিলাম। ব্যোমকেশের মুখ দেখিয়া এমন কিছু বোধ হইল না যে সে আমার উপর চটিয়াছে; কিন্তু মুখ দেখিয়া সকল সময় তাহার মনের ভাব বোঝা যায় না। কে জানে, হয়তো কথাটা ইহাদের কাছে প্রকাশ করিয়া অন্যায় করিয়াছি, ব্যোমকেশ নির্জনে পাইলেই আমার মুণ্ড চিবাইবে।
কালীগতি হঠাৎ বলিলেন, ‘আমার বোধ হয় আপনি ভুলই করেছেন ব্যোমকেশবাবু। হরিনাথ সম্ভবত মরেনি।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ কালীগতির পানে চাহিয়া রহিল, তারপর বলিল, ‘আপনি নতুন কিছু জানতে পেরেছেন?’
কালীগতি ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না-তাকে ঠিক জানা বলা চলে না; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে ঐ বনের মধ্যে লুকিয়ে আছে।’
ব্যোমকেশ চমকিত হইয়া বলিল, ‘বনের মধ্যে? এই দারুণ শীতে?’
‘হ্যাঁ। বনের মধ্যে কাপালিকের ঘর বলে একটা কুঁড়ে ঘর আছে–রাত্রে বাঘ ভালুকের ভয়ে সম্ভবত সেই ঘরটায় লুকিয়ে থাকে।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘স্পষ্ট কোনো প্ৰমাণ পেয়েছেন কি?’
‘না। তবে আমার স্থির বিশ্বাস সে ঐখানেই আছে।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না।
রাত্ৰে শয়ন করিতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘চোরাবালির কথাটাও চারিদিকে রাষ্ট্র করে দিয়েছ তো?’
‘না না–আমি শুধু কথায় কথায় বলেছিলুম। যে–?’
‘বুঝেছি।’ বলিয়া সে চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া হাসিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, ‘তুমি তো ও কথা বলতে বারণ করনি।’
‘তোমার মনের ভাব দেখছি রবিবাবুর গানের নায়কের মত—যদি বারণ কর তবে গাহিব না। এবং বারণ না করিলেই তারস্বরে গাহিব। যা হোক, আজ দুপুরবেলা কি করলে বল।’
দেখিলাম, ব্যোমকেশ সত্যসত্যই চটে নাই; বোধহয় ভিতরে ভিতরে তাহার ইচ্ছা ছিল যে ও কথাটা আমি প্ৰকাশ করিয়া ফেলি। অন্তত তাহার কাজের যে কোনো ব্যাঘাত হয় নাই তাহা নিঃসন্দেহ।
আমি তখন দ্বিপ্রহরে যাহা যাহা জানিতে পারিয়াছি সব বলিলাম; মন্ত্র-লেখা কাগজটাও দেখাইলাম। কাগজটা ব্যোমকেশ মন দিয়া দেখিল, কিন্তু বিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিল না। বলিল, নুতন কিছুই নয়—এসব আমার জানা কথা। এই লেখাটার দ্বিতীয় লাইন সম্পূর্ণ করলে হবে–
‘রাত্রি ১১টা ৪৫মিঃ গতে অমাবস্যা পড়িবে। অর্থাৎ হরিনাথও পাঁজি দেখেছিল!’
হিমাংশুবাবুর বহিৰ্গমনের কথা শুনিয়া ব্যোমকেশ মুচকি হাসিল, কোন মন্তব্য করিল না। আমি তখন বলিলাম, ‘দ্যাখ ব্যোমকেশ, আমার মনে হয়। হিমাংশুবাবু আমাদের কাছে কিছু লুকোবার চেষ্টা করছেন। তুমি লক্ষ্য করেছ কি না জানি না, কিন্তু আমাদের অতিথিরূপে পেয়ে তিনি খুব খুশি হননি।’
ব্যোমকেশ মৃদুভাবে আমার পিঠ চাপড়াইয়া বলিল, ‘ঠিক ধরেছ। হিমাংশুবাবু যে কত উঁচু মেজাজের লোক তা ওঁকে দেখে ধারণা করা যায় না। সত্যি অজিত, ওঁর মতন সহৃদয় প্রকৃত ভদ্রলোক খুব কম দেখা যায়। যেমন করে হোক এ ব্যাপারে একটা রফা করতেই হবে।’
আমাকে বিস্ময় প্রকাশের অবকাশ না দিয়া ব্যোমকেশ পুনশ্চ বলিল, ‘অনাদি সরকারের রাধা। নামে একটি বিধবা মেয়ে আছে শুনেছ বোধহয়। তাকে আজ দেখলুম।’
আমি বোকার মত তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া রহিলাম, সে বলিয়া চলিল, ‘সতের-আঠার বছরের মেয়েটি-দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু দুভাগ্যের পীড়নে আর লজ্জায় একেবারে নুয়ে পড়েছে।—দেখ অজিত, যৌবনের উন্মাদনার অপরাধকে আমরা বড় কঠিন শাস্তি দিই, বিশেষত অপরাধী যদি স্ত্রীলোক হয়। প্রলোভনের বিরাট শক্তিকে হিসাবের মধ্যে নিই না, যৌবনের স্বাভাবিক অপরিণামদৰ্শিতাকেও হিসাব থেকে বাদ দিই। ফলে যে বিচার করি সেটা সুবিচার নয়। আইনেই grave and sudden provocation বলে একটা সাফাই আছে। কিন্তু সমাজ কোনো সাফাই মানে না; আগুনের মত সে নির্মম, যে হাত দেবে তার হাত পুড়বে। আমি সমাজের দোষ দিচ্ছি না–সাধারণের কল্যাণে তাকে কঠিন হতেই হয়। কিন্তু যে-লোক এই কঠিনতার ভিতর থেকে পাথর ফাটিয়ে করুণার উৎস খুলে দেয় তাকে শ্রদ্ধা না করে থাকা যায় না!’
ব্যোমকেশকে কখনো সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে লেকচার দিতে শুনি নাই; অনাদি সরকারের কন্যাকে দেখিয়া তাহার ভাবের বন্যা উথলিয়া উঠিল কেন তাহাও বোধগম্য হইল না। আমি ফ্যালফ্যাল করিয়া কেবল তাহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাসমোচন করিয়া বলিল, ‘আর একটা আশ্চর্য দেখছি, এসব ব্যাপারে মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়। কোন দেয় কে জানে!’
অনেকক্ষণ কোনো কথা হইল না; শেষে ব্যোমকেশ উঠিয়া পায়ের মোজা টানিয়া খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘রাত হল, শোয়া যাক। এ ব্যাপারটা যে কিভাবে শেষ হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। যা কিছু জ্ঞাতব্য সবই জানা হয়ে গেছে—অথচ লোকটাকে ধরবার উপায় নেই।’ তারপর গলা নামাইয়া বলিল, ‘ফাঁদ পাততে হবে, বুঝেছ অজিত, ফাঁদ পাততে হবে।’