চোরাবালি

আমি বলিলাম‌, ‘যদি কিছু বলবে ঠিক করে থাকো তাহলে একটু স্পষ্ট করে বল। জ্ঞাতব্য কোনো কথাই আমি এখনো বুঝতে পারিনি।’

‘কিছু বোঝোনি?’

‘কিছু না।’

‘আশ্চর্য! আমার মনে যা একটু সংশয় ছিল তা আজ শহরে গিয়ে ঘুচে গেছে। সমস্ত ঘটনাটি বায়স্কোপের ছবির মত চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।’

অধর দংশন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম‌, শহরে সারাদিন কি করলে?’

ব্যোমকেশ জামার বোতাম খুলিতে খুলিতে বলিল‌, ‘মাত্র দুটি কাজ। ইস্টিশনে অনাদি সরকারের মেয়েকে দেখলুম–তাকে দেখবার জন্যেই সেখানে লুকিয়ে বসেছিলুম। তারপর রেজিস্ট্রি অফিসে কয়েকটি দলিলের সন্ধান করলুম।’

‘এইতেই এত দেরি হল?’

‘হ্যাঁ। রেজিস্ট্রি অফিসের খবর সহজে পাওয়া যায় না–অনেক তদ্বির করতে হল।’

‘তারপর?’

‘তারপর ফিরে এলুম।’ বলিয়া ব্যোমকেশ লেপের মধ্যে প্রবেশ করিল।

বুঝিলাম‌, কিছু বলিবে না। তখন আমিও রাগ করিয়া শুইয়া পড়িলাম‌, আর কোনো কথা কহিলাম না।

ক্ৰমে তন্দ্ৰবেশ হইল। নিদ্রাদেবীর ছায়া-মঞ্জীর মাথার মধ্যে রুমঝুম করিয়া বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে‌, এমন সময় দরজার কড়া খুঁটু খুঁটু করিয়া নড়িয়া উঠিল। তন্দ্ৰা ছুটিয়া গেল।

ব্যোমকেশের বোধ করি তখনো ঘুম আসে নাই‌, সে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘কে?’

বাহির হইতে মৃদুকণ্ঠে আওয়াজ আসিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, একবার দরজা খুলুন।’

ব্যোমকেশ উঠিয়া দরজা খুলিয়া দিল। সবিস্ময়ে দেখিলাম‌, দেওয়ান কালীগতি একটি কালো রঙের কম্বল গায়ে জড়াইয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

কালীগতি বলিলেন‌, ‘আমার সঙ্গে আসুন‌, একটা জিনিস দেখাতে চাই।—অজিতবাবু্‌, জেগে৷ আছেন নাকি? আপনিও আসুন।’

ব্যোমকেশ ওভারকেট গায়ে দিতে দিতে বলিল‌, ‘এত রাত্ৰে! ব্যাপার কি?’ কালীগতি উত্তর দিলেন না। আমিও লেপি পরিত্যাগ করিয়া একটা শাল ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া লইলাম। তারপর দুইজনে কালীগতির অনুসরণ করিয়া বাহির হইলাম।

বাড়ি হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া আমরা বাগানের ফটকের দিকে চলিলাম। অন্ধকার রাত্রি‌, বহুপূর্বে চন্দ্রাস্ত হইয়াছে। ছুঁচের মত তীক্ষ্ণ অথচ মন্থর একটা বাতাস যেন অলসভাবে বস্ত্ৰাচ্ছাদনের ছিদ্র অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছে। আমি ভাবিতে লাগিলাম‌, বৃদ্ধ এহেন রাত্রে আমাদের কোথায় লইয়া চলিল। কতদূর যাইতে হইবে! ব্যোমকেশই বা এমন নির্বিচারে প্রশ্নমাত্র না করিয়া চলিয়াছে কেন?

কিন্তু ফটক পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই বুঝিলাম‌, আমাদের গন্তব্যস্থান বেশিদূর নয়। কালীগতির বাড়ির সদর দরজায় একটি হ্যারিকেন লণ্ঠন ক্ষীণভাবে জ্বলিতেছিল‌, সেটিকে তুলিয়া লইয়া তাহার বাতি উস্কাইয়া দিয়া কালীগতি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিলেন‌, বলিলেন‌, ‘আসুন।’

কালীগতির বাড়িতে বোধহয় চাকর-বাকির কেহ থাকে না‌, কারণ বাড়িতে প্ৰবেশ করিয়া জনমানবের সাড়াশব্দ পাইলাম না। লন্ঠনের শিখা বাড়ির অংশমাত্র আলোকিত করিল‌, তাহাতে নিকটস্থ দরজা জানালা ও ঘরের অন্যান্য দুএকটা আসবাব ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়িল না। একপ্রস্থ সিঁড়ি ভাঙিয়া আমরা দোতলায় উঠিলাম; তারপর আর এক প্রস্থ সিঁড়ি। এই সিঁড়ির শেষ ধাপে উঠিয়া কালীগতি লণ্ঠন কমাইয়া রাখিয়া দিলেন। দেখিলাম‌, আলিসা-ঘেরা খোলা ছাদে উপস্থিত হইয়াছি।

‘এদিকে আসুন।’ বলিয়া কালীগতি আমাদের আলিসার ধারে লইয়া গেলেন; তারপর বাহিরের দিকে হস্ত প্রসারিত করিয়া বলিলেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছেন?’

উচ্চস্থান হইতে অনেক দূর পর্যন্ত দৃষ্টিগ্রাহ্য হইয়াছিল বটে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকার দৃষ্টির পথরোধ করিয়া দিয়াছিল। তাই চারিদিকে অভেদ্য তমিস্রা ছাড়া আর কিছুই দেখা গেল না। কেবল কালীগতির অঙ্গুলি-নির্দেশ অনুসরণ করিয়া দেখিলাম বহুদূরে একটি মাত্র আলোকের বিন্দু চক্রবালশায়ী মঙ্গলগ্রহের মত আরক্তিমভাবে জ্বলিতেছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটা আলো জ্বলছে। কিম্বা আগুনও হতে পারে। কোথায় জ্বলছে?’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘জঙ্গলের ধারে যে কুঁড়ে ঘরটা আছে তারই মধ্যে।’

‘ও-যাতে সেই কাপালিক মহাপ্ৰভু ছিলেন। তা-তিনি কি আবার ফিরে এলেন নাকি?’ ব্যোমকেশের ব্যঙ্গহাসি শুনা গেল।

‘না–আমার বিশ্বাস এ হরিনাথ মাস্টার।’

‘ওঃ!’ ব্যোমকেশ যেন চমকিয়া উঠিল–’আজ সন্ধ্যেবেলা আপনি বলছিলেন বটে। কিন্তু আলো জ্বেলে সে কি করছে?’

‘বোধহয় শীত সহ্য করতে না পেরে আগুন জ্বেলেছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল‌, শেষে মৃদুস্বরে বলিল‌, ‘হতেও পারে–হতেও পারে। যদি সে বেঁচে থাকে—অসম্ভব নয়।’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, সে বেঁচে আছে–ঐ আগুনই তার প্রমাণ। মনুষ্যসমাজ থেকে যে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে সে ছাড়া এই রাত্রে ওখানে আর কে আগুন জ্বালবে?’

‘তা বটে!’ ব্যোমকেশ আবার কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন হইয়া রহিল‌, তারপর বলিল‌, ‘হরিনাথ মাস্টার হোক বা না হোক‌, লোকটাকে জানা দরকার অজিত‌, এখন ওখানে যেতে রাজী আছ?’

আমি শিহরিয়া উঠিয়া বলিলাম‌, ‘এখন? কিন্তু–’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘সব দিক বিবেচনা করে দেখুন। এখন গেলে যদি তাকে ধরতে পারেন। তাহলে এখনি যাওয়া উচিত। কিন্তু এই অন্ধকারে কোনো রকম শব্দ না করে কুঁড়ে ঘরের কাছে এগুতে পারবেন কি? আলো নিয়ে যাওয়া চলবে না‌, কারণ আলো দেখলেই সে পালাবে। আর অন্ধকারে বন-বাদােড় ভেঙে যেতে গেলেই শব্দ হবে। কি করবেন‌, ভাল করে ভেবে দেখুন।’

0 Shares