তিনজনে মিলিয়া পরামর্শ করিলাম। সব দিক ভাবিয়া শেষে স্থির হইল যে আজ রাত্রে যাওয়া হইবে না; কারণ আসামী যদি একবার টের পায় তাহা হইলে আর ওঘরে আসিবে না।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেওয়ানজীর পরামর্শই ঠিক, আজ যাওয়া সমীচীন নয়। আমার মাথায় একটা মতলব এসেছে। আসামী যদি ভড়কে না যায় তাহলে কালও নিশ্চয় আসবে। কাল আমি আর অজিত আগে থাকতে গিয়ে ঐ ঘরে লুকিয়ে থাকিব–বুঝছেন? তারপর সে যেমনি আসবে—‘
কালীগতি বলিলেন, ‘এ প্রস্তাব মন্দ নয়। অবশ্য এর চেয়েও ভাল মতলব যদি কিছু থাকে তাও ভেবে দেখা যাবে। আজ তাহলে এই পর্যন্ত থাক।’
ছাদ হইতে নামিয়া আমরা নিজেদের ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। দেওয়ানজী আমাদের দ্বার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া গেলেন। যাইবার সময় ব্যোমকেশের মুখের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনি তান্ত্রিকধর্মেবিশ্বাস করেন না?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না, ওসব বুজরুকি। আমি যত তান্ত্রিক দেখেছি, সব বেটা মাতাল আর লম্পট।’
কালীগতির চোখের দৃষ্টি ক্ষণকালের জন্য কেমন যেন ঘোলাটে হইয়া গেল, তিনি মুখে একটু ক্ষীণ হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজ তবে শুয়ে পড়ুন। ভাল কথা, হিমাংশু বাবাজীকে আপাতত এসব কথা না বললেই বোধহয় ভাল হয়।’
ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, তাঁকে এখন কিছু বলবার দরকার নেই।’
কালীগতি প্ৰস্থান করিলেন। আমরা আবার শয়ন করিলাম। কিয়ৎকাল পরে ব্যোমকেশ বলিল, ‘ব্ৰাহ্মণ আমার ওপর মনে মনে ভয়ঙ্কর চটেছেন।’
আমি বলিলাম, যাবার সময় তোমার দিকে যেরকম ভাবে তাকালেন তাতে আমারও তাই মনে হল। তান্ত্রিকদের সম্বন্ধে ওসব কথা বলবার কি দরকার ছিল? উনি নিজে তান্ত্রিক–কাজেই ওঁর আঁতে ঘা লেগেছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমিও কায়মনোবাক্যে তাই আশা করছি।’
তাহার কথা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না। কাহারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিয়া কথা কওয়া তাহার অভ্যাস নয়, অথচ এক্ষেত্রে সে জানিয়া বুঝিয়াই আঘাত দিয়াছে। বলিলাম, তার মানে? ব্ৰাহ্মণকে মিছিমিছি চটিয়ে কোন লাভ হল নাকি?’
‘সেটা কাল বুঝতে পারব। এখন ঘুমিয়ে পড়।’ বলিয়া সে পাশ ফিরিয়া শুইল।
পরদিন সকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত ব্যোমকেশ অলসভাবে কাটাইয়া দিল। হিমাংশুবাবুকে আজ বেশ প্রফুল্ল দেখিলাম–নানা কথাবাতায় হাসি তামাসায় শিকারের গল্পে আমাদের চিত্তবিনোদন করিতে লাগিলেন। আমরা যে একটা গুরুতর রহস্যের মর্মোদ্ঘাটনের জন্য তাঁহার অতিথি হইয়াছি তাহা যেন তিনি ভুলিয়াই গেলেন; একবারও সে প্রসঙ্গের উল্লেখ করিলেন না।
বৈকালে চা-পান সমাপ্ত করিয়া ব্যোমকেশ কালীগতিকে একান্তে লইয়া গিয়া ফিসফিস করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘কালকের প্ল্যানই ঠিক আছে তো?’
কালীগতি চিন্তান্বিতভাবে কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের মুখের পানে তাকাইয়া থাকিয়া বলিলেন, ‘আপনি কি বিবেচনা করেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমার বিবেচনায় যাওয়াই ঠিক, এর একটা নিম্পত্তি হওয়া দরকার। আজ রাত্রি দশটা নাগাদ চন্দ্রাস্ত হবে, তার আগেই আমি আর অজিত গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে থাকব। যদি কেউ আসে তাকে ধরব।’
কালীগতি বলিলেন, ‘যদি না আসে?’
‘তাহলে বুঝব আমার আগেকার অনুমানই ঠিক, হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।’
আবার কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া কালীগতি বলিলেন, ‘বেশ, কিন্তু ঘরটা এখন গিয়ে একবার দেখে এলে ভাল হত। চলুন, আপনাদের নিয়ে যাই।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চলুন। ঘরটা বেলাবেলি দেখে না রাখলে আবার রাত্রে সেখানে যাবার অসুবিধা হবে।’
ঘরটা যে আমরা আগে দেখিয়াছি তাহা ব্যোমকেশ ভাঙিল না।
যথা সময় তিনজন বনের ধারে কুটীরে উপস্থিত হইলাম। কালীগতি আমাদের কুটীরের ভিতরে লইয়া গেলেন। দেখিলাম, মেঝের উপর একন্তুপ ছাই পড়িয়া আছে। তা ছাড়া ঘরের আর কোনো পরিবর্তন হয় নাই।
কালীগতি পিছনের কবাট খুলিয়া বালুর দিকে লইয়া গেলেন। বালুর উপর তখন সন্ধ্যার মলিনতা নামিয়া আসিতেছে। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল, ‘বাঃ। এদিকটা তো বেশ, যেন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।’
আমি দেখাদেখি বলিলাম, ‘চমৎকার!’
কালীগতি বলিলেন, ‘আপনারা আজ রাত্রে এই ঘরে থাকবেন বটে। কিন্তু আমার একটু দুর্ভাবনা হচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, একটা বাঘ নাকি সম্প্রতি জঙ্গলে এসেছে।’
আমি বলিলাম, ‘তাতে কি, আমরা বন্দুক নিয়ে আসব।’
কালীগতি মৃদু হাসিয়া মাথা নাড়িলেন, ‘বাঘা যদি আসে, অন্ধকারে বন্দুক কোনো কাজেই লাগবে না। যা হোক, আশা করি বাঘের গুজবটা মিথ্যে–বন্দুক আনবার দরকার হবে না; তবে সাবধানের মার নেই, আপনাদের সতর্ক করে দিই। যদি রাত্ৰে বাঘের ডাক শুনতে পান, ঘরের মধ্যে থাকবেন না, এই দিকে বেরিয়ে এসে আগলি লাগিয়ে দেবেন, তারপর ঐ বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন। যদি বা বাঘ ঘরে ঢোকে বালির ওপর যেতে পারবে না।’
ব্যোমকেশ খুশি হইয়া বলিল, ‘সেই ভাল–বন্দুকের হাঙ্গামায় দরকার নেই। অজিত আবার নূতন বন্দুক চালাতে শিখেছে, হয়তো বিনা কারণেই আওয়াজ করে বসবে; ফলে শিকার আর এদিকে ঘেঁষবে না।’
তারপর বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম। মনটা কুহেলিকায় আচ্ছন্ন হইয়া রহিল।
সন্ধ্যার পর হিমাংশুবাবুর অস্ত্রাগারে বসিয়া গল্পগুজব হইল।
এক সময় ব্যোমকেশ হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা হিমাংশুবাবু্, মনে করুন কেউ যদি একটা নিরীহ নির্ভরশীল লোককে জেনেশুনে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পাঠিয়ে দেয় তার শাস্তি কি?’