হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘মৃত্যু। A tooth for a tooth, an eye for an eye!’
ব্যোমকেশ আমার দিকে ফিরিল–’আজত, তুমি কি বল?’
‘আমিও তাই বলি।’
ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ উৰ্ধৰ্বমুখে বসিয়া রহিল। তারপর উঠিয়া গিয়া দরজার বাহিরে উঁকি মারিয়া দরজা ভেজাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিল। মৃদুস্বরে বলিল, ‘হিমাংশুবাবু্, আজ রাত্রে আমরা দু’জনে গিয়ে কাপালিকের কুঁড়োয় লুকিয়ে থাকব।’
বিস্মিত হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘সে কি! কেন?’
ব্যোমকেশ সংক্ষেপে কারণ ব্যক্ত করিয়া শেষে কহিল, ‘কিন্তু আমাদের একলা যেতে সাহস হয় না। আপনাকেও যেতে হবে।’
হিমাংশুবাবু সোৎসাহে বলিলেন, ‘বেশ বেশ, নিশ্চয় যাব।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কিন্তু আপনি যাচ্ছেন একথা যেন আকারে ইঙ্গিতেও কেউ না জানতে পারে। তা হলেই সব ভেস্তে যাবে। শুনুন, আমরা আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় বাড়ি থেকে বেরুব; আপনি তার আধঘন্টা পরে বেরুবেন, কেউ যেন জানতে না পারে। এমন কি, আমাদের যাবার কথা। আপনি জানেন সে ইঙ্গিতও দেবেন না।’
‘বেশ।’
‘আর আপনার সবচেয়ে ভােল রাইফেলটা সঙ্গে নেবেন। আমরা শুধু হাতেই যাব।’
রাত্ৰি ন’টার মধ্যে আহারাদি শেষ করিয়া আমরা নিজেদের ঘরে প্রবেশ করিলাম। সাজগোজ করিয়া বাহির হইতে ঠিক সাড়ে ন’টা বাজিল।
বাগান পার হইয়া মাঠে পদার্পণ করিয়াছি। এমন সময় চাপা কণ্ঠে কে ডাকিল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’
পাশে তাকাইয়া দেখিলাম, একটা গাছের আড়াল হইতে বাহির হইয়া কালীগতি আসিতেছেন। তিনি বোধহয় এতক্ষণ আমাদের জন্য প্ৰতীক্ষা করিতেছিলেন, কাছে আসিয়া বলিলেন, যাচ্ছেন? বন্দুক নেননি দেখছি। বেশ–মনে রাখবেন, যদি বাঘের ডাক শুনতে পান, বালির ওপর গিয়ে দাঁড়াবেন।’
‘হ্যাঁ–মনে আছে।’
চন্দ্ৰ অস্ত যাইতে বিলম্ব নাই, এখনি বনের আড়ালে ঢাকা পড়িবে। কালীগতির মৃদুকথিত ‘দুর্গা দুর্গা’ শুনিয়া আমরা চলিতে আরম্ভ করিলাম।
কুটীরে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ পকেট হইতে টর্চ বাহির করিল, নিমেষের জন্য একবার জ্বালিয়া ঘরের চারিদিক দেখিয়া লইল। তারপর নিজে মাটির উপর উপবেশন করিয়া বলিল, ‘বোসে।’
আমি বসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘সিগারেট ধরাতে পারি?’
‘পারো। তবে দেশলাইয়ের আলো হাত দিয়ে আড়াল করে রেখো।’
দুজনে উক্তরূপে দেশলাই জ্বালিয়া সিগারেট ধরাইয়া নীরবে টানিতে লাগিলাম।
আধঘণ্টা পরে বাহিরে একটু শব্দ হইল। ব্যোমকেশ ডাকিল, ‘হিমাংশুবাবু আসুন।’
হিমাংশুবাবু রাইফেল লইয়া আসিয়া বসিলেন। তখন তিনজনে সেই কুঁড়ে ঘরের মেঝোয় বসিয়া দীর্ঘ প্রতীক্ষা আরম্ভ করিলাম। মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে দুএকটা কথা হইতে লাগিল। হিমাংশুবাবুর কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির রেডিয়ম-দ্যুতি সময়ের নিঃশব্দ সঞ্চার জ্ঞাপন করিতে লাগিল।
বারোটা বাজিয়া পঁচিশ মিনিটের সময় একটা বিকট গম্ভীর শব্দ শুনিয়া তিনজনেই লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। বন্য বাঘের ক্ষুধার্তা ডাক আগে কখনো শুনি নাই–বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কাঁপিয়া উঠিল। হিমাংশুবাবু চাপা গলায় বলিলেন, ‘বাঘ।‘ তাহার রাইফেলে খুট্ করিয়া শব্দ হইল, বুঝিলাম তিনি রাইফেলে টোটা ভরিলেন।
বাঘের ডাকটা বনের দিক হইতে আসিয়াছিল। হিমাংশুবাবু পা টিপিয়া টিপিয়া খোলা দরজার পাশে গিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার গাঢ়তর দেহরেখা অন্ধকারের ভিতর অস্পষ্টভাবে উপলব্ধি হইল। আমরা নিস্তব্ধভাবে দাঁড়াইয়া রহিলাম।
হিমাংশুবাবু ফিসফিস করিয়া বলিলেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’
‘শব্দভেদী’–ব্যোমকেশের স্বর যেন বাতাসে মিলাইয়া গেল। হিমাংশুবাবু শুনিতে পাইলেন কি না জানি না, তিনি কুটীরের বাহিরে দুই পদ অগ্রসর হইয়া বন্দুক তুলিলেন।
এই সময় আবার সেই দীর্ঘ হিংস্র আওয়াজ যেন মাটি পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিল। এবার শব্দ আরো কাছে আসিয়াছে, বোধহয় পঞ্চাশ গজের মধ্যে। শব্দের প্রতিধ্বনি মিলাইয়া যাইতে না। যাইতে হিমাংশুবাবুর বন্দুকের নল হইতে একটা আগুনের রেখা বাহির হইল। শব্দ হইল–কড়াৎ!
সঙ্গে সঙ্গে দূরে একটা গুরুভার পতনের শব্দ। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘পড়েছে। ব্যোমকেশবাবু্, টর্চ বার করুন।’
টর্চ ব্যোমকেশের হাতেই ছিল, সে বোতাম টিপিয়া আলো জ্বলিল; ঘর হইতে বাহির হইয়া আগে আগে যাইতে যাইতে বলিল, ‘আসুন।’
আমরা তাহার পশ্চাতে চলিলাম। হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘বেশি কাছে যাবেন না; যদি শুধু জখম হয়ে থাকে—‘
কিন্তু বাঘ কোথায়? বনের ঠিক কিনারায় একটা কালো কম্বল-ঢাকা কি যেন পড়িয়া রহিয়াছে। নিকটে গিয়া টর্চের পরিপূর্ণ আলো তাহার উপর ফেলিতেই হিমাংশুবাবু চীৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘একি! এ যে দেওয়ানজী!’
দেওয়ান কালীগতি কাৎ হইয়া ঘাসের উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহার রক্তাক্ত নগ্ন বক্ষ হইতে কম্বলটা সরিয়া গিয়াছে। চক্ষু উন্মুক্ত; মুখের একটা পাশবিক বিকৃতি তাঁহার অন্তিমকালের মনোভাব ব্যক্ত করিতেছে।
ব্যোমকেশ ঝুঁকিয়া তাঁহার বুকের উপর হাত রাখিল, তারপর সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘গতাসু। যদি প্রেতলোক বলে কোনো রাজ্য থাকে তাহলে এতক্ষণে হরিনাথ মাস্টারের সঙ্গে দেওয়ানজীর মুলাকাত হয়েছে।’
তাহার মুখে বা কণ্ঠস্বরে মর্মপীড়ার কোনো আভাসই পাওয়া গেল না।