চোরাবালি

হিসাবের খাতা কয়টা হিমাংশুবাবুর দিকে ঠেলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এগুলো ভাল করে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবেন‌, এক লক্ষ টাকা দেনা কেন হয়েছে।’

আমরা তিনজনে বৈঠকখানায় ফরাসের উপর বসিয়াছিলাম। কালীগতির মৃত্যুর পর দুই দিন অতীত হইয়াছে। তাঁহার লোহার সিন্দুক ভাঙিয়া হিসাবের খাতা চারিটা ও আরও অনেক দলিল ব্যোমকেশ বাহির করিয়াছিল।

হিমাংশুবাবুর চক্ষু হইতে বিভীষিকার ছায়া তখনো সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় নাই। তিনি করতলে চিবুক রাখিয়া বসিয়াছিলেন‌, বোমকেশের কথায় মুখ তুলিয়া বলিলেন‌, ‘এখনো যেন আমি কিছু বুঝতে পারছি না–ভাবতে গেলেই সব গুলিয়ে যাচ্ছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার বর্তমান মানসিক অবস্থায় গুলিয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। আমি টুকরো টুকরো প্রমাণ থেকে এই রহস্য কাহিনীর যে কাঠামো খাড়া করতে পেরেছি তা আপনাকে বলছি‌, শুনুন। কিন্তু তার আগে এই রেজিস্ট্রি দলিলগুলো নিন।’

‘কি এগুলো?’ বলিয়া হিমাংশুবাবু দলিলগুলি হাতে লইলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি যে-মহাজনের কাছে তমসুক লিখে টাকা ধার নিয়েছিলেন‌, সেই মহাজন সেই সব তমসুক রেজিস্ট্রি করে কালীগতিকে বিক্রি করে। এগুলো হচ্ছে সেই সব তমসুক আর তার বিক্রি কবালা।’

‘কালীগতি এইসব তমসুক কিনেছিলেন?’

‘হ্যাঁ‌, আপনার টাকায় কিনেছিলেন; যাকে বলে মাছের তেলে মাছ ভাজা।’

হিমাংশুবাবু উদভ্ৰান্তভাবে দেয়ালের পানে তাকাইয়া রহিলেন। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওগুলো এখন ছিঁড়ে ফেলতে পারেন‌, কারণ কালীগতি আর আপনার কাছ থেকে টাকা আদায় করতে আসবেন না। তিনি ঋণের দায়ে আপনার আস্ত জমিদারীটাই নিলাম করে নেবেন ভেবেছিলেন–আরো বছর দুই এইভাবে চালাতে পারলে করতেনও তাই। কিন্তু মাঝ থেকে ঐ ন্যালাখ্যাপা অঙ্ক-পাগলা মাস্টারটা এসে সব ভণ্ডুল করে দিলে।’

আমি বলিলাম‌, ‘না না‌, ব্যোমকেশ‌, গোড়া থেকে বল।’

ব্যোমকেশ ধীরভাবে একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল‌, ‘গোড়া থেকেই বলছি। হিমাংশুবাবুর বাবা মারা যাবার পর কালীগতি যখন দেখলেন যে নূতন জমিদার বিষয় পরিচালনায় উদাসীন তখন তিনি ভারী সুবিধা পেলেন। হিসাবের খাতা তিনি লেখেন‌, তাঁর মাথার ওপর পরীক্ষা করবার কেউ নেই—সুতরাং তিনি নিৰ্ভয়ে কিছু কিছু টাকা তছরূপ করতে আরম্ভ করলেন। এইভাবে কিছুদিন চলল। কিন্তু নাল্পে সুখমস্তি–ও প্রবৃত্তিটা ক্রমশ বেড়েই চলে। এদিকে জমিদারীর আয়-ব্যয়ের একটা বাঁধা হিসেব আছে‌, বেশি গরমিল হলেই ধরা পড়বার সম্ভাবনা। তিনি তখন এক মস্ত চাল চললেন‌, বড় বড় প্রজাদের সঙ্গে মোকদ্দমা বাধিয়ে দিলেন। খরচ আর বাঁধাবাঁধির মধ্যে রইল না; আদালতে ন্যায্য এবং ন্যায়-বহির্ভূত দুই রকমই খরচ আছে‌, সুতরাং স্বচ্ছন্দে গোঁজামিল দেওয়া চলে। কালীগতির চুরির খুব সুবিধা হল।

‘প্রথমটা বোধহয় কালীগতি কেবল চুরি করবার মতলবেই ছিলেন‌, তার বেশি উচ্চাশা করেননি। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক তান্ত্ৰিক এসে হাজির হল–এবং আপনি প্রথমেই তার বিষ-নজরে পড়ে গেলেন। কালীগতি তার কাছ থেকে মন্ত্র নিলেন; সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কুমন্ত্রণা গ্ৰহণ করলেন। আমার বিশ্বাস এই কাপালিকই জমিদারী আত্মসাৎ করবার পরামর্শ কালীগতিকে দেয়; কারণ হিসেবের খাতা থেকে দেখতে পাচ্ছি‌, সে আসবার পর থেকেই চুরির মাত্রা বেড়ে গেছে।

‘স্বাভাবিক লোভ ছাড়াও একটা ধর্মান্ধতার ভাব কালীগতির মধ্যে ছিল। ধর্মান্ধতা মানুষকে কত নৃশংস করে তুলতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে বিরল নয়। কালীগতি গুরুর প্ররোচনায় অন্নদাতার সর্বনাশ করতে উদ্যত হলেন। তিনি যে কৌশলটি বার করলেন সেটি যেমন সহজ তেমনি কার্যকর। প্রথমে আপনার টাকা চুরি করে তহবিল খালি করে দিলেন‌, পরে খরচের টাকা নেই। ওই অজুহাতে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়ালেন‌, এবং শেষে মহাজনের কাছ থেকে আপনারই টাকায় সেই তমসুক কিনে নিলেন। কালীগতি বিনা খরচে আপনার উত্তমৰ্ণে হয়ে দাঁড়ালেন। আপনি কিছুই জানতে পারলেন না।

‘এইভাবে বেশ আনন্দে দিন কাটছে‌, হঠাৎ একদিন কোথা থেকে হরিনাথ এসে হাজির হল। আপনি তাকে বেবির মাস্টার রাখলেন। বড় ভালুমানুষ বেচারা‌, দু’চার দিনের মধ্যে কালীগতির ভক্ত হয়ে উঠল; কালীগতি তাকে তান্ত্রিক ধর্ম-মাহাত্ম্য শেখাতে লাগলেন। কালীমূর্তির এক পট হরিনাথ তাঁর কাছ থেকে এনে নিজের ঘরের দেওয়ালে ভক্তিভরে টাঙিয়ে রাখলে।

‘কিন্তু শুধু ধর্মে তার পেট ভরে না–সে অঙ্ক-পাগল। বেবিকে সে যোগ বিয়োগ শেখায়‌, আর নিজের মনে বেবির খাতায় বড় বড় অঙ্ক কষে। কিন্তু তবু নিজের কল্পিত অঙ্কে সে সুখ পায় না।

‘একদিন আলমারি খুলে সে হিসেবের খাতাগুলো দেখতে পেলে। অঙ্কের গন্ধ পেলে সে আর স্থির থাকতে পারে না–মহা আনন্দে সে খাতাগুলো পরীক্ষা করতে আরম্ভ করে দিলে। যতই হিসেবের মধ্যে ঢুকতে লাগল‌, ততই দেখলে হাজার হাজার টাকার গরমিল। হরিনাথ স্তম্ভিত হয়ে গেল।

‘কিন্তু এই আবিষ্কারের কথা সে কাকে বলবে? আপনার সঙ্গে তার বড় একটা দেখা হয় না‌, উপরন্তু আপনার সঙ্গে উপযাচক হয়ে দেখা করতে সে সাহস করে না। এ অবস্থায় যা সবচেয়ে স্বাভাবিক সে তাই করলে–কালীগতিকে গিয়ে হিসেব গরমিলের কথা বললে।

‘কালীগতি দেখলেন–সর্বনাশ। তাঁর এতদিনের ধারাবাহিক চুরি ধরা পড়ে যায়। তিনি তখনকার মত হরিনাথকে স্তোকবাক্যে বুঝিয়ে মনে মনে সঙ্কল্প করলেন যে‌, হরিনাথকে সরাতে হবে‌, এবং এই সঙ্গে ঐ খাতাগুলো। নইলে তাঁর দুষ্কৃতির প্রমাণ থেকে যাবে। এতদিন যে সেগুলো কোনো ছুতোয় নষ্ট করে ফেলেননি এই অনুতাপ তাঁকে ভীষণ নিষ্ঠুর করে তুলল।

0 Shares