চোরাবালি

আমাদের থলি ক্ৰমে ভরিয়া উঠিতে লাগিল। বেলাও অলক্ষিতে বাড়িয়া চলিয়াছিল। আমি একবার এক কার্তুজে-দশ নম্বর-সাতটা হরিয়াল মারিয়া আত্মশ্লাঘার সপ্তমস্বর্গে চড়িয়া গিয়াছিলাম—দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়ছিল আমার মত অব্যৰ্থ সন্ধান সেকালে অৰ্জ্জুনেরও ছিল না। ব্যোমকেশ দুইবার মাত্র বন্দুক চালাইয়া—একবার একটা খরগোশ ও দ্বিতীয়বার একটা ময়ুর মারিয়াই–থামিয়া গিয়াছিল। তাহার চক্ষু বৃহত্তর শিকারের অনুসন্ধান করিয়া ফিরিতেছিল। বনে হরিণ আছে; তা ছাড়া বাঘ না হোক‌, ভালুকের আশা সে সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতে পারে নাই। তাই কুঞ্জ মহুয়া গাছে তখনও ফল পাকে নাই শুধু তাহার ভালুক সুৰক্ষা সেই দিকেই সতর্ক ইয়া কিন্তু বেলা যতই বাড়িতে লাগিল‌, জঙ্গলের বাতাসের গুণে পেটের মধ্যে অগ্নিদেব ততই প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। আমরা তখন জঙ্গলের পূর্বসীমা লক্ষ্য করিয়া চলিতে আরম্ভ করিলাম।

কুমার ত্ৰিদিবের বন্দুকের আওয়াজ দূর হইতে বরাবরই শুনিতে পাইতেছিলাম‌, এখন দেখিলাম তিনিও পূর্বদিকে মোড় লইয়াছেন।

বনভূমির ঘন সন্নিবিষ্ট গাছ ক্রমে পাতলা হইয়া আসিতে লাগিল। অবশেষে আমরা রৌদ্রোজ্জ্বল খোলা জায়গায় নীল আকাশের তলায় আসিয়া দাঁড়াইলাম। সম্মুখেই বালুকার একটা বিস্তীর্ণ বলয়-প্ৰায় সিকি মাইল চওড়া; দৈর্ঘ্যে কতখানি তাহা আন্দাজ করা গেল না-বনের কোল ঘোষিয়া অর্ধচন্দ্রাকারে পড়িয়া আছে। বালুর উপর সূর্যকিরণ পড়িয়া চক চকু করিতেছে; শীতের প্রভাতে দেখিতে খুব চমৎকার লাগিল।

এই বালু-বলয় জঙ্গলকে পূর্বদিকে আর অগ্রসর হইতে দেয় নাই। কোনো সুদূর অতীতে হয়তো ইহা একটি স্রোতস্বিনী ছিল‌, তারপর প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে-হয়তো ভূমিকম্পে-খাত উচু হইয়া জল শুকাইয়া গিয়া শুষ্ক বালুপ্ৰান্তরে পরিণত হইয়াছে।

আমরা বালুর কিনারায় বসিয়া সিগারেট ধরাইলাম।

অল্পকাল পরেই কুমার ত্রিদিব আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন‌, ‘দিব্যি ক্ষিদে পেয়েছে।–না? ঐ যে দুযোধন পৌঁছে গেছে—চলুন।’

এতক্ষণ লক্ষ্য করি নাই‌, কুমার ত্ৰিদিবের ওড়িয়া বাবুর্চি মোটর হইতে বাস্কেট নামাইয়া ইতিমধ্যে হাজির হইয়াছিল। অনতিদূরে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপর সাদা তোয়ালে বিছাইয়া খাদ্যদ্রব্য সাজাইয়া রাখিতে ছিল। তাহাকে দেখিয়া কুলায় প্রত্যাশী সন্ধ্যার পাখির মত আমরা সেই দিকে ধাবিত হইলাম।

আহার করিতে করিতে‌, কে কি পাইয়াছে তাহার হিসাব হইল। দেখা গেল‌, আমার এক কার্তুজে সাতটা হরিয়াল সত্ত্বেও‌, কুমার বাহাদুরই জিতিয়া আছেন।

আকণ্ঠ আহার ও অনুপান হিসাবে থার্মোফ্লাস্ক হইতে গরম চা নিঃশেষ করিয়া আবার সিগারেট ধরানো গেল। কুমার ত্রিদিব গাছের গুড়িতে ঠেসান দিয়া বসিলেন‌, সিগারেটে সুদীর্ঘ টান দিয়া অর্ধনিমীলিত চক্ষে কহিলেন‌, ‘এই যে বালুবন্ধ দেখছেন এ থেকেই জমিদারীর নাম হয়েছে চোরাবালি। এদিকটা সব হিমাংশুর।’ বলিয়া পূর্বদিক নির্দেশ করিয়া হাত নাড়িলেন।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমিও তাই আন্দাজ করেছিলুম। এই বালির ফালিটা লম্বায় কতখানি? সমস্ত বনটাকেই ঘিরে আছে নাকি?’

কুমার বলিলেন‌, ‘না। মাইল তিনেক লম্বা হবে-তারপর আমার মাঠ আরম্ভ হয়েছে। এরই মধ্যে কোথায় এক জায়গায় খানিকটা চোরাবালি আছে—ঠিক কোনখানটায় আছে। কেউ জানে না‌, কিন্তু ভয়ে কোনো মানুষ বালির উপর দিয়ে হাঁটে না; এমন কি গরু বাছুর শেয়াল কুকুর পর্যন্ত একে এড়িয়ে চলে৷’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বালিতে কোথাও জল নেই বোধহয়?’

কুমার অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়িলেন‌, ‘বলতে পারি না। শুনেছি ঐদিকে খানিকটা জায়গায় জল আছে, তাও সব সময় পাওয়া যায় না।’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে যেখানে বালুর রেখা বাঁকিয়া বনের আড়ালে অদৃশ্য হইয়াছে সেই দিকে আঙুল দেখাইলেন।

এই সময় হঠাৎ অতি নিকটে বনের মধ্যে বন্দুকের আওয়াজ শুনিয়া আমরা চমকিয়া উঠিয়া বসিলাম। আমরা তিনজনেই এখানে রহিয়াছি‌, তবে কে আওয়াজ করিল–বিস্মিতভাবে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিয়া এই কথা ভাবিতেছি‌, এমন সময় একজন বন্দুকধারী লোক একটা মৃত খরগোশ কান ধরিয়া ঝুলাইতে ঝুলাইতে জঙ্গল হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহার পরিধানে যোধপুরী ব্রীচেস‌, মাথায় বয়-স্কাউটের মত খাকি টুপি‌, চামড়ার কোমরবন্ধে সারি সারি কার্তুজ আটা রহিয়াছে।

কুমার ত্রিদিব উচ্চহাস্য করিয়া বলিলেন‌, ‘আরো হিমাংশু‌, এস এস।’

খরগোশ মাটিতে ফেলিয়া হিমাংশুবাবু আমাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন; বলিলেন‌, ‘অভ্যর্থনা আমারই করা উচিত এবং করছিও। বিশেষত এদের।’ কুমার আমাদের পরিচয় করাইয়া দিলেন, তারপর হাসিয়া হিমাংশুবাবুকে বলিলেন‌, ‘তুমি বুঝি আর লোভ সামলাতে পারলে না? কিম্বা ভয় হল‌, পাছে তোমার সব বাঘ আমরা ব্যাগ করে ফেলি?’

হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘আরে বল কেন? মহা ফ্যাসাদে পড়া গেছে। আজই আমার ত্রিপুরায় যাবার কথা ছিল‌, সেখান থেকে শিকারের নেমস্তন্ন পেয়েছি। কিন্তু যাওয়া হল না‌, দেওয়ানজী আটকে দিলেন। বাবার আমলের লোক‌, একটু ছুতো পেলেই জুলুম জবরদস্তি করেন‌, কিছু বলতেও পারি না। তাই রাগ করে আজ সকালবেলা বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। দুর্ত্তোর! কিছু না হোক দুটো বনপায়রাও তো মারা যাবে।’

কুমার বলিলেন‌, ‘হায় হায়–কোথায় বাঘ ভাল্লুক আর কোথায় বনপায়রা! দুঃখ হবার কথা বটে–কিন্তু যাওয়া হল না কেন?’

0 Shares