চোরাবালি

‘এইখানে এই কাহিনীর সবচেয়ে ভয়াবহ। আর রোমাঞ্চকর ঘটনার আবির্ভাব। হরিনাথকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে‌, অথচ ছুরি ছোরা চালানো বা বিষ-প্রয়াগ চলবে না। তবে উপায়?

‘যে চোরাবালি থেকে আপনার জমিদারীর নামকরণ হয়েছে সেই চোরাবালির সন্ধান কালীগতি জানতেন। সম্ভবত তাঁর গুরু কাপালিকের কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন; কারণ চোরাবালিটা কাপালিকের কুঁড়ের ঠিক পিছনেই। আমরাও সেদিন সকালে পাখি মারতে গিয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে সেই ভয়ঙ্কর চোরাবালির সন্ধান পেয়েছিলুম।

‘কালীগতি মাস্টারকে সরাবার এক সম্পূর্ণ নূতন উপায় উদ্ভাবন করলেন। চমৎকার উপায়। হরিনাথ মাস্টার মরবে। অথচ কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে মরেছে। তাঁর ওপর সন্দেহের ছায়াপাত পর্যন্ত হবে না‌, বরঞ্চ খাতাগুলো অন্তর্ধানের বেশ একটা স্বাভাবিক কারণ পাওয়া যাবে।

‘গত অমাবস্যার দিন তিনি হরিনাথকে বললেন‌, ‘তুমি যদি মন্ত্রসিদ্ধ হতে চাও তো আজ রাত্রে ঐ কুঁড়ে ঘরে গিয়ে মন্ত্র সাধনা কর।’ হরিনাথ রাজী হল; সে বেবির খাতায় মন্ত্রটা লিখে কাগজটা ছিঁড়ে নিয়ে নিজের কাছে রাখল।

‘রাত্রে সবাই ঘুমুলে হরিনাথ নিজের ঘর থেকে বার হল। সে সাধনা করতে যাচ্ছে‌, তার জামা জুতো পরিবার দরকার নেই‌, এমন কি সে চশমাটাও সঙ্গে নিল না—কারণ অমাবস্যার রাত্রে চশমা থাকা না থাকা সমান।

‘কালীগতি তাকে কুটীর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলেন। আসবার সময় বলে এলেন—’যদি বাঘের ডাক শুনতে পাও ভয় পেও না‌, পিছনের দরজা দিয়ে বালির ওপর গিয়ে দাঁড়িও; সেখানে বাঘ যেতে পারবে না।’

‘হরিনাথ জপে বসল। তারপর যথাসময়ে বাঘের ডাক শুনতে পেল। সে কি ভয়ঙ্কর ডাক‌, তা আমরাও সেদিন শুনেছি। হিমাংশুবাবুর মত পাকা শিকারীও বুঝতে পারেননি যে এ নকল ডাক। কালীগতি জন্তু-জানোয়ারের ডাক অদ্ভুত নকল করতে পারতেন। প্রথম দিন এখানে এসেই আমরা তাঁর শেয়াল ডাক শুনেছিলুম।

‘বাঘের ডাক শুনে অভাগা হরিনাথ ছুটে গিয়ে বালির ওপর দাঁড়াল এবং সঙ্গে সঙ্গে চোরাবালির অতল গহ্বরে তলিয়ে গেল। একটা চীৎকার হয়তো সে করেছিল। কিন্তু তাও অর্ধপথে চাপা পড়ে গেল। তার ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কথা ভাবলে গা শিউরে ওঠে।’

একটু চুপ করিয়া ব্যোমকেশ আবার বলিতে লাগিল‌, ‘কালীগতি কার্য সুসম্পন্ন করে ফিরে এসে সেই রাত্ৰেই হরিনাথের ঘর থেকে খাতা সরিয়ে ফেললেন। তার পরদিন যখন হরিনাথকে পাওয়া গেল না। তখন রটিয়ে দিলেন যে সে খাতা চুরি করে পালিয়েছে।

‘হরিনাথের অন্তর্ধানের কৈফিয়ৎ বেশ ভালই হয়েছিল। কিন্তু তবু কালীগতি সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। কে জানে যদি কেউ সন্দেহ করে যে‌, হরিনাথ শুধু খাতা নিয়ে পালাবে কেন? নিশ্চয় এর মধ্যে কোন গূঢ় তত্ত্ব আছে। তখন তিনি সিন্দুক থেকে ছ’হাজার টাকাও সরিয়ে ফেললেন। এই সময়ে আপনার চাবি হারিয়েছিল‌, সুতরাং সন্দেহটা সহজেই কালীগতির ঘাড় থেকে নেমে গেল—সবাই ভাবলে হারানো চাবির সাহায্যে হরিনাথই টাকা চুরি করেছে। কালীগতির ডবল লাভ হল‌, টাকাও পেলেন‌, আবার হরিনাথের অপরাধও বেশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠল।

‘তারপর আমি আর অজিত এলুম। এই সময়ে বাড়িতে আর একটা ব্যাপার ঘটছিল যার সঙ্গে হরিনাথের অন্তর্ধানের কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাপারটা আমাদের সমাজের একটা চিরন্তন ট্র্যাজেডি—বিধবার পদস্খলন‌, নূতন কিছু নয়। অনাদি সরকারের বিধবা মেয়ে রাধা একটি মৃত সন্তান প্রসব করে। তারা অনেক যত্ন করে কথাটা লুকিয়ে রেখেছিল‌, কিন্তু শেষে আপনার স্ত্রী জানতে পারেন। তিনি তৎক্ষণাৎ আপনাকে এসে বলেন যে‌, এসব অনাচার এ বাড়িতে চলবে না‌, ওদের আজই বিদেয় করে দাও–কেমন‌, ঠিক কি না?’

শেষের দিকে হিমাংশুবাবু বিস্ফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের দিকে তাকাইয়া ছিলেন‌, এখন একবার ঘাড় নাড়িয়া নীরবে জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিলেন।

ব্যোমকেশ বলিতে লাগিল‌, ‘কিন্তু আপনার মনে দয়া হল; আপনি ঐ অভাগী মেয়েটাকে কলঙ্কের বোঝা মাথায় চাপিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারলেন না। এই নিয়ে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে একটু মনোমালিন্যও হয়েছিল। যা হোক‌, আপনি যখন বুঝলেন যে ওরা ভ্রূণহত্যার অপরাধে অপরাধী নয়‌, তখন রাধাকে চুপি চুপি তার মাসীর কাছে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করলেন। পাছে আপনার আমলা বা চাকর-বাকরদের মধ্যেও জানাজানি হয়‌, এই জন্যে নিজে গাড়ি চালিয়ে তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে এলেন।

‘অনাদি সরকারের ভাগ্য ভাল যে আপনার মত মনিব পেয়েছে; অন্য কোনো মালিক এতটা করত বলে আমার মনে হয় না।

‘সে যা হোক‌, এই ব্যাপারের সঙ্গে হরিনাথের অন্তর্ধানের ঘটনা জড়িয়ে গিয়ে সমস্তটা আমার কাছে অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠেছিল। তারপর অতি কষ্টে জট ছাড়ালুম; রাধাকে দেখবার জন্যে স্টেশনে গিয়ে লুকিয়ে বসে রইলুম। তার চেহারা দেখেই বুঝলুম এ ব্যাপারের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নেই–তার ট্র্যাজেডি অন্য রকম। তখন আর সন্দেহ রইল না যে কালীগতিই হরিনাথকে খুন করেছেন। লোকটি কতবড় নৃশংস আর বিবেকহীন তার জ্বলন্ত প্রমাণ পেলুম রেজিস্ট্রি অফিসে। কিন্তু তাঁকে ধরবার উপায় নেই; যে খাতাগুলো থেকে তাঁর চুরি-অপরাধ প্রমাণ হতে পারত সেগুলো তিনি আগেই সরিয়েছেন। হয়তো পুড়িয়ে ফেলেছেন‌, নয়তো হরিনাথের সঙ্গে ঐ চোরাবালিতেই ফেলে দিয়েছেন।

‘কালীগতি প্রথমটা বেশ নিশ্চিন্তই ছিলেন। কিন্তু যখন অজিতের মুখে শুনলেন যে হরিনাথের মৃত্যুর কথা আমি বুঝতে পেরেছি তখন তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। প্রথমে তিনি আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে হরিনাথ মরেনি‌, প্রমাণস্বরূপ নিজেই কুঁড়ে ঘরে আগুন জ্বেলে রেখে এসে দুপুর রাত্রে আমাদের দেখালেন। আমি তখন এমন ভাব দেখাতে লাগলুম যেন তাঁর কথা সত্যি হলেও হতে পারে। আমরা ঠিক করলুম রাত্রে গিয়ে কুঁড়ে ঘরে পাহারা দেব। তিনি রাজী হলেন বটে। কিন্তু কাউকে একথা বলতে বারণ করে দিলেন।

0 Shares