চোরাবালি

হিমাংশুবাবু ইতিমধ্যে খাবার বাক্সটা নিজের দিকে টানিয়া লইয়া তাহার ভিতর অনুসন্ধান করিতেছিলেন‌, প্ৰফুল্লমুখে কয়েকটা ডিম-সিদ্ধ ও কাটলেট বাহির করিয়া চর্বণ করিতে আরম্ভ করিলেন। আমি এই অবসরে তাঁহার চেহারাখানা ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। বয়স আমাদেরই সমান হইবে; বেশ মজবুত পেশীপুষ্ট দেহ। মুখে একজোড়া উগ্র জামান গোঁফ মুখখানাকে অনাবশ্যক রকম হিংস্ৰ করিয়া তুলিয়াছে। চোখের দৃষ্টিতে পুরাতন বাঘ-শিকারীর নিষ্ঠুর সতর্কতা সর্বদাই উঁকি ঝুকি মারিতেছে। এক নজর দেখিলে মনে হয় লোকটা ভীষণ দুদন্তি। কিন্তু তবু বর্তমানে তাঁহাকে পরম পরিতৃপ্তির সহিত অৰ্ধমুদিত নেত্ৰে কাটলেট চিবাইতে দেখিয়া আমার মনে হইল‌, চেহারাটাই তাঁহার সত্যকার পরিচয় নহে; বস্তৃত লোকটি অত্যন্ত সাদাসিধা অনাড়ম্বর-মনের মধ্যে কোনো মারপ্যাঁচ নাই। সাংসারিক বিষয়ে হয়তো একটু অন্যমনস্ক; নিদ্রায় জাগরণে নিরস্তুর বাঘ ভালুকের কথা চিন্তা করিয়া বোধ করি বুদ্ধিটাও সাংসারিক ব্যাপারের অনুপযোগী হইয়া পড়িয়াছে।

কাটলেট ও ডিম্ব সমাপন্যান্তে চায়ের ফ্লাস্কে চুমুক দিয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘কি বললে? যাওয়া হল না কেন? নেহাত বাজে কারণ; কিন্তু দেওয়ানজী ভয়ানক ভাবিত হয়ে পড়েছেন‌, পুলিসকেও খবর দেওয়া হয়েছে। কাজেই অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমাকে এখানে ঘাঁটি আগলে বসে থাকতে হবে।’ তাঁহার কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ও অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

‘হয়েছে কি?’

‘হয়েছে আমার মাথা। জন তো‌, বাবা মারা যাবার পর থেকে গত পাঁচ বছর ধরে প্রজাদের সঙ্গে অনবরত মামলা মোকদ্দমা চলছে। আদায় তসিলও ভাল হচ্ছে না। এই নিয়ে অষ্টপ্রহর অশান্তি লেগে আছে্‌,–উকিল মোক্তার পরামর্শ‌, সে সব তো তুমি জানোই। যা হোক‌, আমমোক্তারনামা দিয়ে এক রকম নিশ্চিন্দি হওয়া গিছিল‌, এমন সময় আবার এক নূতন ফ্যাচাং—। মাস-কয়েক আগে বেবির জন্য একটা মাস্টার রেখেছিলুম‌, সে হঠাৎ পরশু দিন থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে; যাবার সময় নাকি খানকয়েক পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গেছে। তাই নিয়ে একেবারে তুলাকালাম কাণ্ড। থানা পুলিস হৈ হৈ রৈ রৈ বেধে গেছে। দেওয়ানজীর বিশ্বাস‌, এটা আমার মামলাবাজ প্রজাদের একটা মারাত্মক প্যাঁচ।’

ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘লোকটা এখনো ধরা পড়েনি?’

বিমৰ্ষভাবে ঘাড় নাড়িয়া হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘না। এবং যতক্ষণ না ধরা পড়ছে–হঠাৎ থামিয়া গিয়া কিছুক্ষণ বিস্ফারিত নেত্ৰে ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আরে! এটা এতক্ষণ আমার মাথাতেই ঢোকেনি। আপনি তো একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ্‌্‌, চোর-ডাকাতের সাক্ষাৎ যম! (ব্যোমকেশ মৃদুস্বরে বলিল‌, সত্যান্বেষী) তাহলে মশায়‌, দয়া করে যদি দু’একদিনের মধ্যে লোকটাকে খুঁজে বার করে দিতে পারেন—তাহলে আমার ত্রিপুরার শিকারটা ফস্কায় না। কাল-পরশুর মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে—’

আমরা সকলে হাসিয়া উঠিলাম। কুমার ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘চোরের মন পুঁই আদাড়ে। তুমি বুঝি কেবল শিকারের কথাই ভাবছ?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমাকে কিছু করতে হবে না‌, পুলিসই খুঁজে বার করবে অখন। এসব জায়গা থেকে একেবারে লোপাট হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়; কলকাতা হলেও বা কথা ছিল।’

হিমাংশুবাবু মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘পুলিসের কর্ম নয়। এই তিন দিনে সমস্ত দেশটা তারা তোলপাড় করে ফেলেছে‌, কাছাকাছি যত রেলওয়ে স্টেশন আছে সব জায়গায় পাহারা বসিয়েছে। কিন্তু এখনো তো কিছু করতে পারলে না। দোহাই ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনি কেসটা হাতে নিন; সামান্য ব্যাপার‌, আপনার দুঘণ্টাও সময় লাগবে না।’

ব্যোমকেশ তাঁহার আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়া মৃদুহাস্যে বলিল‌, ‘আচ্ছা‌, ঘটনাটা আগাগোড়া বলুন তো শুনি।’

হিমাংশুবাবু সাক্ষাতে হাত উল্টাইয়া বলিলেন‌, ‘আমি কি সব জানি ছাই! তার সঙ্গে বোধহয় সাকুল্যে পাঁচ দিনও দেখা হয়নি। যা হোক‌, যতটুকু জানি বলছি শুনুন। কিছুদিন আগে-বোধহয় মাস দুই হবে-একদিন সকালবেলা একটা ন্যালাখ্যাপী গোছের ছোকরা আমার কাছে এসে হাজির হল। তাকে আগে কখনো দেখিনি‌, এ অঞ্চলের লোক বলে বোধ হল না। তার গায়ে একটা ছেড়া কামিজ‌, পায়ে ছেড়া চটিজুতা-রোগা বেঁটে দুৰ্ভিক্ষ-পীড়িত চেহারা; কিন্তু কথাবাত শুনে মনে হয় শিক্ষিত। বললে‌, চাকরির অভাবে খেতে পাচ্ছে না‌, যা হোক একটা চাকরি দিতে হবে। জিজ্ঞাসা করলুম‌, কি কাজ করতে পার? পকেট থেকে বি-এসসি’র ডিগ্রি বার করে দেখিয়ে বললে‌, যে কাজ দেবেন। তাই করব। ছোকরার অবস্থা দেখে আমার একটু দয়া হল‌, কিন্তু কি কাজ দেব? সেরেস্তায় তো একটা জায়গাও খালি নেই। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল‌, আমার মেয়ে বেবির জন্যে একজন মাস্টার রাখবার কথা গিন্নি কয়েকদিন আগে বলেছিলেন‌, বেবি এই সাতে পড়েছে‌, সুতরাং তাঁর পড়াশুনোর দিকে এবার একটু বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

‘তাকে মাস্টার বাহাল করলুম‌, কারণ‌, অবস্থা যাই হোক‌, ছোকরা শিক্ষিত ভদ্রসন্তান। বাড়িতেই বাইরের একটা ঘরে তার থাকবার ব্যবস্থা করে দিলুম। ছোকরা কৃতজ্ঞতায় একেবারে কেঁদে ফেললে। তখন কে ভেবেছিল যে–; নাম? নাম যতদূর মনে পড়ছে‌, হরিনাথ চৌধুরী–কায়স্থ।

‘যা হোক‌, সে বাড়িতেই রইল। কিন্তু আমার সঙ্গে বড় একটা দেখা-সাক্ষাৎ হত না। বেবিকে দুবেলা পড়াচ্ছে‌, এই পর্যন্তই জানতুম। হঠাৎ সেদিন শুনলুম‌, ছোকরা কাউকে না বলে কবে উধাও হয়েছে। উধাও হয়েছে‌, হয়েছে-আমার কোনো আপত্তি ছিল না‌, কিন্তু মাঝ থেকে কতকগুলো বাজে পুরনো হিসেবের খাতা নিয়ে গিয়েই আমার সর্বনাশ করে গেল। এখন তাকে খুঁজে বার না করা পর্যন্ত আমার নিস্তার নেই।’

0 Shares