হিমাংশুবাবু নীরব হইলেন। ব্যোমকেশ ঘাসের উপর লম্বা হইয়া শুইয়া শুনিতেছিল, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘ছোকরা খেত কোথায়?’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘আমার বাড়িতেই খেত। আদর যত্নের ক্রুটি ছিল না, বেবির মাস্টার বলে গিন্নি তাকে নিজে—‘
এই সময় পিছনে একটা গাছের মাথায় ফট্ ফট্ শব্দ শুনিয়া আমরা মাথা তুলিয়া দেখিলাম, একটা প্ৰকাণ্ড বন-মোরগ নানা বর্ণের পুচ্ছ ঝুলাইয়া এক গাছ হইতে অন্য গাছে উড়িয়া যাইতেছে। গাছ দুটার মধ্যে ব্যবধান ত্ৰিশ হাতের বেশি হইবে না। কিন্তু নিমিষের মধ্যে বন্দুকের ব্রীচ্ খুলিয়া টোটা ভরিয়া হিমাংশুবাবু ফায়ার করিলেন। পাখিটা অন্য গাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারিল না, মধ্য পথেই ধপ্ করিয়া মাটিতে পড়িল।
আমি সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিলাম, ‘কি অদ্ভুত টিপ।’
ব্যোমকেশ সপ্ৰশংস নেত্ৰে চাহিয়া বলিল, ‘সত্যিই অসাধারণ।’
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘ও আর কি দেখলেন? ওর চেয়েও ঢের বেশি আশ্চর্য বিদ্যে ওর পেটে আছে!–হিমাংশু, তোমার সেই শব্দভেদী প্যাঁচটা একবার দেখাও না।’
‘আরে না না, এখন ওসব থাক। চল—আর একবার জঙ্গলে ঢোকা যাক—’
‘সে হচ্ছে না–ওটা দেখাতেই হবে। নাও–চোখে রুমাল বাঁধো।’
হিমাংশুবাবু হাসিয়া বলিলেন, ‘কি ছেলেমানুষী দেখুন দেখি। ও একটা বাজে ট্রীক, আপনারা কতবার দেখেছেন—‘
আমরাও কৌতুহলী হইয়া উঠিয়াছিলাম, বলিলাম, ‘তা হোক, আপনাকে দেখাতে হবে।’
তখন হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘আচ্ছা–দেখাচ্ছি। কিছুই নয়, চোখ বেঁধে কেবল শব্দ শুনে লক্ষ্যবোধ করা।’ বন্দুকে একটা বুলেট ভরিয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু্, আপনিই রুমাল দিয়ে চোখ বেঁধে দিন–কিন্তু দেখবেন কান দুটো যেন খোলা থাকে।’
ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া বেশ শক্ত করিয়া তাঁহার চোখ বাঁধিয়া দিল। তখন কুমার ত্রিদিব একটা চায়ের পেয়ালা লইয়া তাহার হাতলে খানিকটা সূতা বাঁধলেন। তারপর পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া–যাহাতে হিমাংশুবাবু বুঝিতে না পারেন তিনি কোনদিকে গিয়াছেন–প্ৰায় পাঁচশ হাত দূরে একটা গাছের ডালে পেয়ালাটা ঝুলাইয়া দিলেন।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হিমাংশুবাবু্, এবার শুনুন।’
কুমার ত্রিদিব চামচ দিয়া পেয়ালাটায় আঘাত করিলেন, ঠুং করিয়া শব্দ হইল। হিমাংশুবাবু বন্দুক কোলে লইয়া যেদিক হইতে শব্দ আসিল সেই দিকে ঘুরিয়া বসিলেন। বন্দুকটা একবার তুলিলেন, তারপর বলিলেন, ‘আর একবার বাজাও।’
কুমার ত্রিদিব আর একবার শব্দ করিয়া ক্ষিপ্ৰপদে সরিয়া আসিলেন।
শব্দের রেশ সম্পূর্ণ মিলাইয়া যাইবার পূর্বেই বন্দুকের আওয়াজ হইল; দেখিলাম পেয়ালাটা চুৰ্ণ হইয়া উড়িয়া গিয়াছে, কেবল তাহার ডাঁটিটা ডাল হইতে ঝুলিতেছে।
মুগ্ধ হইয়া গেলাম। পেশাদার বাজীকরের সাজানো নাট্যমঞ্চে এরকম খেলা দেখা যায় বটে কিন্তু তাহার মধ্যে অনেক রকম জুয়াচুরি আছে। এ একেবারে নির্জলা খাঁটি জিনিস।
হিমাংশুবাবু চোখের রুমাল খুলিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘হয়েছে?’
আমাদের মুক্তকণ্ঠ প্ৰশংসা শুনিয়া তিনি একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলেন। ঘড়ির দিকে তাকাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন, ‘ও কথা থাক, আপনাদের সুখ্যাতি আর বেশিক্ষণ শুনলে আমার গণ্ডদেশ ক্রমে বিলিতি বেগুনের মত লাল হয়ে উঠবে। এখন উঠন। চলুন, ইতর প্ৰাণীদের বিরুদ্ধে আর একবার অভিযানে বেরুনো যাক।’
২
বেলা দেড়টার সময়, শিকার-শ্রান্ত চারিজন মোটরের কাছে ফিরিয়া আসিলাম। হরিনাথ মাস্টারের খাতা চুরির কাহিনী চাপা পড়িয়া গিয়াছিল। হিমাংশুবাবুরও কি জানি কেন, ব্যোমকেশের সাহায্য লইবার আর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বোধহয় এরূপ তুচ্ছ ব্যাপারে সদ্য পরিচিত একজন লোককে খাটাইয়া লইতে তিনি কুষ্ঠিত হইতেছিলেন; হয়তো তিনি ভাবিতেছিলেন যে পুলিসই শীঘ্র এই ব্যাপারে একটা সমাধান করিয়া ফেলিবে। সে যাহাই হোক, ব্যোমকেশই প্রসঙ্গটা পুনরুত্থাপন করিল, বলিল, ‘আপনার হরিনাথ মাস্টারের গল্পটা ভাল করে শোনা হল না।’
হিমাংশুবাবু মােটরের ফুট-বোর্ডে পা তুলিয়া দিয়া বলিলেন, ‘আমি যা জানি সবই প্রায় বলেছি, আর বিশেষ কিছু জািনবার আছে বলে মনে হয় না।’
ব্যোমকেশ আর কিছু বলিল না। কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘চল হিমাংশু, তোমাকে মোটরে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাই। তুমি বোধ হয় হেঁটেই এসেছি।’
হিমাংশুবাবু বলিলেন, ‘হ্যাঁ। তবে রাস্তা দিয়ে ঘুর পড়ে বলে ওদিক দিয়ে মাঠে মাঠে এসেছি। ওদিক দিয়ে মাইলখানেক পড়ে।’ বলিয়া দক্ষিণ দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন।
কুমার ত্রিদিব বলিলেন, ‘রাস্তা দিয়ে অন্তত মাইল দুই। চল, তোমাকে পৌঁছে দিই।‘ তারপর হাসিয়া বলিলেন, ‘আর যদি নেমস্তন্ন কর তাহলে না হয় দুপুরের স্নানাহারটা তোমার বাড়িতেই সারা যাবে। কি বলেন। আপনারা?’
আমাদের কোনো আপত্তিই ছিল না, আমোদ করিতে আসিয়াছি, গৃহস্বামী যেখানে লইয়া যাইবেন সেখানে যাইতেই রাজী ছিলাম। আমরা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইলাম। হিমাংশুবাবু বলিয়া উঠিলেন, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়-সে। আর বলতে। তোমরা তো আজ আমারই অতিথি—এতক্ষণ এ প্রস্তাব না করাই আমার অন্যায় হয়েছে। যা হোক, উঠে পড়ুন গাড়িতে, আর দেরি নয়; খাওয়া দাওয়া করে। তবু একটু বিশ্রাম করতে পারেন। তারপর একেবারে বৈকালিক চা সেরে বাড়ি ফিরলেই হবে।’