চোরাবালি

এ পর্যন্ত বলিয়া দেওয়ানজী থামিলেন‌, তারপর ঈষৎ কুষ্ঠিতভাবে বলিলেন‌, ‘নানা কারণে কিছুদিন থেকে তহবিলে টাকার কিছু টানাটানি পড়েছে। সম্প্রতি মোকদ্দমার খরচ ইত্যাদি বাবদ কিছু টাকার দরকার হয়েছিল‌, তাই মহাজনের কাছ থেকে ছ হাজার টাকা হাওলাত নিয়ে সিন্দুকে রাখা হয়েছিল। টাকাটা পুটলি বাঁধা অবস্থায় সিন্দুকের এক কোণে রাখা ছিল। ইতিমধ্যে অনেকবার সিন্দুক খুলেছি। কিন্তু পুটলি খুলে দেখবার কথা একবারও মনে হয়নি। আজ সদর থেকে উকিল টাকা চেয়ে পাঠিয়েছেন। পুটলি খুলে টাকা বার করতে গেলুম; দেখি‌, নোটের তাড়ার বদলে কতকগুলো পুরনো খবরের কাগজ রয়েছে।’

দেওয়ান নীরব হইলেন।

শুনিতে শুনিতে ব্যোমকেশ আবার চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িয়াছিল‌, কড়িকাঠে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল‌, ‘তাহলে সিন্দুকের তালা ঠিকই আছে? চাবি কার কাছে থাকে?’

দেওয়ান বলিলেন‌, ‘সিন্দুকের দুটো চাবি; একটা আমার কাছে থাকে্‌্‌, আর একটা হিমাংশু। বাবাজীর কাছে। আমার চাবি ঠিকই আছে‌, কিন্তু হিমাংশু বাবাজীর চাবিটা শুনছি। ক’দিন থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

হিমাংশুবাবু শুষ্কমুখে বলিলেন‌, ‘আমারই দোষ। চাবি আমার কোনোকালে ঠিক থাকে না‌, কোথায় রাখি ভুলে যাই। এবারেও কয়েকদিন থেকে চাবিটা খুঁজে পাচ্ছিলুম না‌, কিন্তু সেজন্যে বিশেষ উদ্বিগ্ন হইনি-ভেবেছিলুম কোথাও না কোথাও আছেই—’

‘হুঁ’–ব্যোমকেশ উঠিয়া বসিল‌, হাসিয়া বেবিকে নিজের কোলের উপর বসাইয়া বলিল‌, ‘মা-লক্ষ্মীর মাস্টারটি জুটেছিল ভাল। কিন্তু তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই আশ্চর্য। ভাল করে খোঁজ করা হচ্ছে তো?’

দেওয়ান কালীগতি বলিলেন‌, ‘যতদূর সাধ্য ভাল করেই খোঁজ করানো হচ্ছে। পুলিস তো আছেই‌, তার ওপর আমিও লোক লাগিয়েছি। কিন্তু কোনো সংবাদই পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘কবে ফিরে আসবেন?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘জানি না। বোধ হয়। আর আসবেন না।’

বেবির চোখ দুটি ছলছল করিয়া উঠিল; তাহা দেখিয়া ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি মাস্টারমশাইকে খুব ভালবাস–না?’

বেবি ঘাড় নীড়িল—’হ্যাঁ-খুব ভালবাসি। তিনি আমাকে কত অঙ্ক শেখাতেন।—আচ্ছা‌, বল তো‌, সাত-নাম কত হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ক’ত? চৌষট্টি?’

বেবি বলিল‌, ‘দ্যুৎ! তুমি কিছু জান না। সাত-নাম তেষট্টি! আচ্ছা‌, তুমি মা কালীর স্তব জানো?’

ব্যোমকেশ হতাশভাবে বলিল‌, ‘না। মা কালীর স্তবও কি তোমার মাস্টারমশায় শিখিয়েছিলেন নাকি?’

‘হ্যাঁ–শুনবে?’ বলিয়া বেবি সুর করিয়া আরম্ভ করিল—

‘নমস্তে কালিকা দেবী করল বদনী—‘

কালীগতি ইষদহাস্যে তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন‌, ‘বেবি‌, তোমার কালীস্তব আমরা পরে শুনিব‌, এখন তুমি বাগানে খেলা কর গে যাও।’

বেবি একটু ক্ষুন্নভাবে পুতুল লইয়া প্ৰস্থান করিল। কালীগতি আস্তে আস্তে বলিলেন‌, ‘লোকটা মাস্টার হিসেবে মন্দ ছিল না-বেশ যত্ন করে পড়াত—অথচ—‘

ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল‌, বলিল‌, ‘চলুন‌, মাস্টারের ঘরটা একবার দেখে আসা যাক।’

বাড়ির সম্মুখস্থ লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে একটি প্রকোষ্ঠ; দ্বারে তালা লাগানো ছিল‌, দেওয়ানজী কষি হইতে চাবির গুচ্ছ বাহির করিয়া তালা খুলিয়া দিলেন। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলাম।

ঘরটি আয়তনে ছোট। গোটা-দুই কাঠের কবাটযুক্ত আলমারি; টেবিল চেয়ার তক্তপোশেই এমনভাবে ভরিয়া উঠিয়াছে যে মনে হয় পা বাড়াইবার স্থান নাই। দ্বারের বিপরীত দিকে একটা ছোট জানোলা ছিল‌, সেটা খুলিয়া দিয়া ব্যোমকেশ ঘরের চারিদিকে একবার চোখ ফিরাইল। তক্তপোশের উপর বিছানাটা অবিন্যস্তভাবে পাট করা রহিয়াছে; টেবিলের উপর সূক্ষ্ম একপুরু ধূলার প্রলেপ পড়িয়াছে; ঘরের অন্ধকার একটা কোণে দড়ি টাঙাইয়া কাপড়-চোপড় রাখিবার ব্যবস্থা। একটা আলমারির কবাট ঈষৎ উন্মুক্ত। দেওয়ালে লন্বিত একখানি কালীঘাটের পটের কালীমূর্তি হরিনাথ মাস্টারের কালীপ্রীতির পরিচয় দিতেছে।

ব্যোমকেশ তক্তপোশের নীচে উঁকি মারিয়া একজোড়া জুতা টানিয়া বাহির করিল, বলিল, ‘তাই তো জুতোজোড়া যে একেবারে নূতন দেখছি। ও—আপনারাই কিনে দিয়েছিলেন বুঝি?’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ।’

‘আশ্চর্য! আশ্চর্য!’ জুতা রাখিয়া দিয়া ব্যোমকেশ দড়ির আলনাটার দিকে গেল। আলনায় কয়েকটা কাচা আকাচা কাপড় জামা বুলিতেছিল‌, সেগুলিকে তুলিয়া তুলিয়া দেখিল‌, তারপর আবার বলিল‌, ‘ভারি আশ্চর্য!’

হিমাংশুবাবু কৌতুহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘কি হয়েছে?’

জবাব দিবার জন্য মুখ ফিরাইয়া ব্যোমকেশ থামিয়া গেল‌, তাহার দৃষ্টি ঘরের বিপরীত কোণে একটা কুলুঙ্গির উপর গিয়া পড়িল। সে দ্রুতপদে গিয়া কুলুঙ্গির ভিতর হইতে কি একটা তুলিয়া লইয়া জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল‌, সবিস্ময়ে বলিল‌, ‘মাস্টার কি চশমা পরত?’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘ওটা বলতে ভুল হয়ে গেছে–পরত বটে। চশমা কি ফেলে গেছে নাকি?’

চশমার কাচের ভিতর দিয়া একবার দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া সহাস্যে সেটা আমার হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ–আশ্চর্য নয়?’

কালীগতি ভুকুঞ্চিত করিয়া কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন‌, ‘আশ্চর্য বটে। কারণ যার চোখ খারাপ তার পক্ষে চশমা ফেলে যাওয়া অস্বাভাবিক। এর কি কারণ হতে পারে আপনার মনে হয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘অনেক রকম কারণ থাকতে পারে। হয়তো তার সত্যি চোখ খারাপ ছিল। না‌, আপনাদের ঠকাবার জন্যে চশমা পরীত।’

0 Shares