চোরাবালি

ইত্যবসরে আমি আর কুমার ত্রিদিব চশমাটা পরীক্ষা করিতেছিলাম। স্টীল ফ্রেমের নড়বড়ে বাহুযুক্ত চশমা‌, কাচ পুরু। কাচের ভিতর দিয়া দেখিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু ধোঁয়া ছাড়া কিছুই দেখিতে পাইলাম না।

কুমার ত্রিদিব বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনার অনুমান বোধহয় ঠিক নয়। চশমাটা অনেকদিনের ব্যবহারে পুরনো হয়ে গেছে আর কাচের শক্তিও খুব বেশি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমার ভুলও হতে পারে। তবে‌, মাস্টার আর কারুর পুরনো চশমা নিয়ে এসেছিল এটাও তো সম্ভব। যা হোক‌, এবার আলমারিটা দেখা যাক।’

খোলা আলমারিটার কবাট উদঘাটিত করিয়া দেখা গেল‌, তাহার মধ্যে থাকে থাকে খেরো-বাঁধানো স্থূলকায় হিসাবের খাতা সাজানো রহিয়াছে—বোধহয় সবসুদ্ধ পঞ্চাশ-ষাটখানা। ব্যোমকেশ উপরের একটা খাতা নামাইয়া দুহাতে ওজন করিয়া বলিল‌, ‘বেশ ভারী আছে‌, সের চারেকের কম হবে না। প্রত্যেক খাতায় বুঝি এক বছরের হিসেব আছে?’

কালীগতি বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ।’

ব্যোমকেশ খাতার গোড়ার পাতা উল্টাইয়া দেখিল‌, পাঁচ বছর আগেকার খাতা‌, ইহার পর হইতে শেষ চার বছরের খাতা চুরি গিয়াছে। আরো কয়েকখানা খাতা বাহির করিয়া ব্যোমকেশ হিসাব রাখিবার প্রণালী মোটামুটি চোখ বুলাইয়া দেখিল। প্রত্যেকটি খাতা দুই অংশে বিভক্ত-অর্থাৎ একাধারে জাবদা ও পাকা খাতা। এক অংশে দৈনন্দিন খুচরা আয়-ব্যয়ের হিসাব লিখিত হইয়াছে—অন্য অংশে মোট দৈনিক খরচ তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। সাধারণত জমিদারী খাতা এরূপভাবে লিখিত হয় না‌, কিন্তু এরূপ লেখার সুবিধা এই যে অল্প পরিশ্রমে জাবদা ও পাকা খাতা মিলাইয়া দেখা যায়।

গোড়া হইতে ব্যোমকেশ ব্যাপারটাকে খুব হাল্কাভাবে লইয়াছিল। অতি সাধারণ গতানুগতিক চুরি ছাড়া ইহার মধ্যে আর কোনো বৈশিষ্ট্য আছে তাহা বোধহয় সে মনে করে নাই। কিন্তু ঘর পরীক্ষা শেষ করিয়া যখন সে বাহিরে আসিল তখন দেখিলাম তাহার চোখের দৃষ্টি প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। ও দৃষ্টি আমি চিনি। কোথাও সে একটা গুরুতর কিছুর ইঙ্গিত পাইয়াছে; হয়তো যত তুচ্ছ মনে করা গিয়াছিল ব্যপার তত তুচ্ছ নয়। আমিও মনে মনে একটু উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম।

ঘরের বাহিরে আসিয়া ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ ভু কুঞ্চিত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল‌, তারপর হিমাংশুবাবুর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘আমি এ ব্যাপারে তদন্ত করি আপনি চান?’

মুহুর্তকালের জন্য হিমাংশুবাবু যেন একটু দ্বিধা করিলেন‌, তারপর বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ-চাই বই কি। এতগুলো টাকা‌, তার একটা কিনারা হওয়া তো দরকার।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে আমাদের দু’জনকে এখানে থাকতে হয়।’

হিমাংশুবাবু বলিল‌, ‘নিশ্চয় নিশ্চয়। সে আর বেশি কথা কি—’

ব্যোমকেশ কুমার ত্ৰিদিবের দিকে ফিরিয়া বলিল‌, ‘কিন্তু কুমার বাহাদুর যদি অনুমতি দেন তবেই আমরা থাকতে পারি। আমরা ওঁর অতিথি।’

কুমার ত্রিদিব লজ্জায় পড়িলেন। আমাদের ছাড়িবার ইচ্ছা তাঁহার ছিল না। কিন্তু ব্যোমকেশের ইচ্ছাটাও তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। ব্যোমকেশ হিমাংশুবাবুর কাজ করিয়া কিছু উপার্জন করিতে চায় এরূপ সন্দেহও হয়তো তাঁহার মনে জাগিয়া থাকিবে। তাই তিনি কুষ্ঠিতভাবে বলিলেন‌, ‘বেশ তো‌, আপনারা থাকলে যদি হিমাংশুর উপকার হয়—’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘তা বলতে পারি না। হয়তো কিছুই করে উঠতে পারবো না। হিমাংশুবাবু্‌, আপনার যদি এ বিষয়ে আগ্রহ না থাকে তো বলুন-চক্ষুলজ্জা করবেন না। আমরা কুমার ত্ৰিদিবের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি‌, বিষয়চিন্তাও কলকাতায় ফেলে এসেছি। তাই‌, আপনি যদি আমাদের সাহায্য দরকার না মনে করেন‌, তাহলে আমি বরঞ্চ খুশিই হব।’

ব্যোমকেশ কুমার বাহাদুরের ভিত্তিহীন সন্দেহটার আভাস পাইয়াছে বুঝিতে পারিয়া তিনি আরো লজ্জিত হইয়া উঠিলেন‌, তাড়াতাড়ি বলিলেন‌, ‘না না ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনারা থাকুন। যতদিন দরকার থাকুন। আপনারা থাকলে নিশ্চয় এ ব্যাপারে। কিনারা করতে পারবেন। আমি রোজ এসে আপনাদের খবর নিয়ে যাব।’

হিমাংশুবাবুঘাড় নাড়িয়া সমর্থন করিলেন। আমাদের থাকাই স্থির হইয়া গেল।

অতঃপর চায়ের ডাক পড়িল; আমরা বৈঠকখানায় ফিরিয়া গেলাম। প্ৰায় নীরবেই চা-পান সমাপ্ত হইল। কুমার ত্রিদিব ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন‌, ‘সাড়ে চারটে বাজে। হিমাংশু‌, আমি তাহলে আজ চলি। কাল আবার কােনো সময় আসব।’ বলিয়া উঠিয়া পড়িলেন।

কম্পাউন্ডের বাহিরে মোটর অপেক্ষা করিতেছিল। আমি এবং ব্যোমকেশ কুমারের সঙ্গে ফটক পর্যন্ত গেলাম। কুমার বাহাদুর নিজের জমিদারীতে আমাদের জন্য অনেক আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছিলেন-পুকুরে মাছ ধরা‌, খালে নীে বিহার প্রভৃতি বহুবিধ ব্যসনের আয়োজন হইয়াছিল। সে সব ব্যর্থ হইয়া যাওয়ায় তিনি একটু ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। মোটরের কাছে পৌঁছিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘এ কাজটায় আপনার কতদিন লাগবে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছুই এখনো বলতে পারছি না-আপনি আমাকে ঘোর অকৃতজ্ঞ মনে করছেন‌, মনে করাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর—আমোদ-আহ্বাদের অছিলায় একে উপেক্ষা করলে অন্যায় হবে।’

কুমার বাহাদুর সচকিত হইয়া বলিলেন‌, ‘তই নাকি! কিন্তু আমার তো অতটা মনে হল না। অবশ্য অনেকগুলো টাকা গেছে—‘

‘টাকা যাওয়াটা নেহাৎ অকিঞ্চিৎকর।’

‘তবে?’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আমার বিশ্বাস হরিনাথ মাস্টার বেঁচে নেই।’

0 Shares