চোরাবালি

আমরা দুজনেই চমকিয়া উঠিলাম। কুমার বলিলেন‌, ‘সে কি?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই মনে হচ্ছে। আশা করি একথা শোনবার পর আমাকে সহজে ক্ষমা করতে পারবেন।’

কুমার উদ্বিগ্নমুখে বলিলেন‌, ‘না না‌, ক্ষমার কোনো কথাই উঠছে না। আপনাকে ছেড়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। একটা লোক যদি খুন হয়ে থাকে—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুনই হয়েছে এমন কথা আমি বলছি না। তবে সে বেঁচে নেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। যা হোক‌, ও আলোচনা আরও প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত মুলতুবি থাক। আপনি কাল আসবেন তো? তাহলে আমাদের সুটকেসগুলোও সঙ্গে করে আনবেন। আচ্ছা—আজ বেরিয়ে পড়ুন–পৌঁছুতে অন্ধকার হয়ে যাবে।’

কুমারের মোটর বাহির হইয়া যাইবার পর আমরা বাড়ির দিকে ফিরিলাম। ফটক হইতে বাড়ির সদর প্রায় একশত গজ দূরে‌, মধ্যের বিস্তৃত ব্যবধান নানা জাতীয় ছোট বড় গাছপালায় পূর্ণ। মাঝে মাঝে লোহার বেঞ্চি পাতিয়া বিশ্রামের স্থান করা আছে।

দেওয়ানের ক্ষুদ্র দ্বিতল বাড়ি দক্ষিণে রাখিয়া আমরা বাগানে প্রবেশ করিলাম। শীতকালের দীর্ঘ গোধূলি তখন নামিয়া আসিতেছে। অবসন্ন দিবার শেষ রক্তিম আভা পশ্চিমে জঙ্গলের মাথায় অলক্ষ্যে সঙ্কুচিত হইয়া আসিতেছে।

ব্যোমকেশ চিন্তিত নতমুখে পকেটে হাত পুরিয়া ধীরে ধীরে চলিয়াছিল; চিন্তার ধারা তাহার কোন সর্পিল পথে চলিয়াছে বুঝিবার উপায় ছিল না। হরিনাথ মাস্টারের ঘরে সে এমন কি পাইয়াছে যাহা হইতে তাহার মৃত্যু অনুমান করা যাইতে পারে-এই কথা ভাবিতে ভাবিতে আমিও একটু অন্যমনস্ক হইয়া পড়িলাম। নিঃকুম পাড়াগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রার মাঝখানে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে‌, অন্তর হইতে যেন গ্ৰহণ করিতে পারিতেছিলাম না। কিন্তু তবু কিছুই বলা যায় না— গুঢ়নক্র হ্রদের উপরিভাগ বেশ প্রসন্নাই দেখায়। ব্যোমকেশের সঙ্গে অনেক রহস্যময় ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট থাকিয়া একটু বুঝিয়েছিলাম যে‌, মুখ দেখিয়া মানুষ চেনা যেমন কঠিন‌, কেবলমাত্র বহিরাবয়ব দেখিয়া কোনো ঘটনার গুরুত্ব নির্ণয় করাও তেমনি দুঃসাধ্য।

একটা ইউক্যালিপ্টাস গাছের তলায় দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইল‌, তারপর উর্ধর্বমুখে চাহিয়া কতকটা আত্মগতভাবেই বলিল‌, ‘জুতো পরে না যাবার একটা কারণ থাকতে পারে‌, জুতো পরে হাঁটলে শব্দ হয়। যে লোক দুপুর রাত্রে চুপি চুপি করে পালাচ্ছে তার পক্ষে খালি পায়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু সে জামা পরবে না কেন? চশমাটাও ফেলে যাবে কেন?

আমি বলিলাম‌, চশমা সম্বন্ধে তুমি বলতে পার‌, কিন্তু জামা পরেনি একথা জানলে কি করে?

ব্যোমকেশ বলিল‌, গুণে দেখলুম সবগুলো জামা রয়েছে। কাজেই প্রমাণ হল যে জামা পরে যায়নি।

আমি বলিলাম‌, তার কতগুলো জামা ছিল তার হিসাব তুমি পেলে কোথেকে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘দেওয়ানজীর কাছ থেকে। তুমি বোধহয় লক্ষ্য করনি‌, ভাণ্ডার থেকে মাস্টারকে দুটো গেঞ্জি আর দুটো জামা দেওয়া হয়েছিল। তা ছাড়া সে নিজে একটা ছেড়া কামিজ পরে এসেছিল। সেগুলো সব আলনায় টাঙানো রয়েছে।’

আমি একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলাম‌, তাহলে তুমি অনুমান কর যে–’

ব্যোমকেশ পশ্চিম আকাশের ক্ষীণ শশিকলার দিকে তাকাইয়া ছিল‌, হঠাৎ সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল‌, ‘ওহে‌, দেখেছ? সবে মাত্ৰ শুক্লপক্ষ পড়েছে। সে রাত্রে কি তিথি ছিল বলতে পারো?’

তিথি নক্ষত্রের সঙ্গে কোনো দিনই সম্পর্ক নাই‌, নীরবে মাথা নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিল‌, ‘বোধহয়–অমাবস্যা ছিল। না‌, চল পাঁজি দেখা যাক।’ তাহার কণ্ঠস্বরে একটা নূতন উত্তেজনার আভাস পাইলাম।

চাঁদের দিকে চাহিয়া কবি এবং নবপ্রণয়ীরা উত্তেজিত হইয়া উঠে জানিতাম; কিন্তু ব্যোমকেশের মধ্যে কবিত্ব বা প্রেমের বাস্পটুকু পর্যন্ত না থাকা সত্ত্বেও সে চাঁদ দেখিয়া এমন উতলা হইয়া উঠিল কেন বুঝিলাম না। যা হোক‌, তাহার ব্যবহার অধিকাংশ সময়েই বুঝিতে পারি না-ওটা অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। তাই সে যখন ফিরিয়া বাড়ির অভিমুখে চলিল‌, তখন আমিও নিঃশব্দে তাহার সহগামী হইলাম।

আমরা বাগানের যে অশংটায় আসিয়া পৌঁছিয়ছিলাম‌, সেখান হইতে বাড়ির ব্যবধােন পঞ্চাশ গজের বেশি হইবে না। সিধা। যাইলে মাঝে কয়েকটা বড় বড় ঝাউয়ের ঝোপ উৰ্ত্তীর্ণ হইয়া যাইতে হয়। ঝাউয়ের ঝোপগুলা বাগানের কিয়দংশ ঘিরিয়া যেন পৃথক করিয়া রাখিয়াছে।

ঘাসের উপর দিয়া নিঃশব্দপদে আমরা প্ৰায় ঝাউ ঝোপের কাছে পৌঁছিয়াছি‌, এমন সময় ভিতর হইতে একটা চাপা কান্নার আওয়াজ পাইয়া আমাদের গতি আপনা হইতেই রুদ্ধ হইয়া গেল। ব্যোমকেশের দিকে চাহিয়া দেখিলাম‌, সে ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া আমাকে নীরব থাকিবার সঙ্কেত জানাইতেছে।

কান্নার ভিতর হইতে একটা ভাঙা গলার আওয়াজ শুনিতে পাইলাম— বাবু্‌, এই অনাদি সরকার আপনাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে–পুরনো চাকর বলে আমাকে দয়া করুন। মা-ঠাকরুণ ভুল বুঝেছেন। আমার মেয়ে অপরাধী—কিন্তু আপনার পা ছুঁয়ে বলছি‌, ও মহাপাপ আমরা করিনি।’

কিছুক্ষণ আর কোনো শব্দ নাই‌, তারপর হিমাংশুবাবুর কড়া কঠিন স্বর শুনা গেল–’ঠিক বলছ? তোমরা মারোনি?’

‘ধর্ম জানেন হুজুর। আপনি মালিক–দেবতা‌, আপনার কাছে যদি মিথ্যে কথা বলি। তবে যেন আমার মাথায় বজ্ৰাঘাত হয়।’

আবার কিছুক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ নাই‌, তারপর হিমাংশুবাবু বলিলেন‌, ‘কিন্তু রাধাকে আর এখানে রাখা চলবে না। কালই তাকে অন্যত্র পাঠাবার ব্যবস্থা কর। একথা যদি জানাজানি হয়। তখন আমি আর দয়া করতে পারব না–এমনিতেই বাড়িতে অশাস্তির শেষ নেই।’

0 Shares