অনাদি ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিল, ‘আজ্ঞে হজুর, কালই তাকে আমি কাশী পাঠিয়ে দেব; সেখানে তার এক মাসী থাকে–’
‘বেশ–যদি খরচ চালাতে না পারো—’ ব্যোমকেশ আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইল। পা টিপিয়া টিপিয়া আমরা সরিয়া গেলাম।
মিনিট পনেরো পরে অন্য দিক দিয়া ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। বারান্দার উপরে দাঁড়াইয়া কালীগতিবাবু একজন নিম্নতন কর্মচারীর সহিত কথা বলিতেছিলেন, বেবি তাঁহার হাত ধরিয়া আব্দারের সুরে কি একটা উপরোধ করিতেছিল—তাহার কথার খানিকটা শুনিতে পাইলাম, ‘একবারটি ডাকো না–’
কালীগতি একটু বিব্রত হইয়া বলিলেন, ‘আঃ পাগলি–এখন নয়।’
বেবি অনুনয় করিয়া বলিল, ‘না দেওয়ানদাদু, একবারটি ডাকো, ঐ ওঁরা শুনবেন।’ বলিয়া আমাদের নির্দেশ করিয়া দেখাইল।
কালীগতি আমাদের দেখিয়া অগ্রসর হইয়া আসিলেন, যে আমলাটি দাঁড়াইয়া ছিল তাহাকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিয়া, প্রশান্ত হাস্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বাগানে বেড়াচ্ছিলেন বুঝি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ–বেবি কি বলছে? কাকে ডাকতে হবে?’
কালীগতি মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিলেন, ‘ওর যত পাগলামি। এখন শেয়াল-ডাক ডাকতে হবে।’
আমি সবিস্ময়ে বলিলাম, ‘সে কি রকম?’
কালীগতি বেবির দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘এখন কাজের সময়, এখন বিরক্ত করতে নেই। যাও-মা’র কাছে গিয়ে একটু পড়তে বসো গে।’
বেবি কিন্তু ছাড়িবার পাত্রী নয়, সে তাঁহার আঙুল মুঠি করিয়া ধরিয়া বলিতে লাগিল, ‘না দাদু, একবারটি—‘
অগত্যা কালীগতি চুপি চুপি তাহার কানের কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলেন, ‘তুমি যখন ঘুমুতে যাবে তখন শোনাব–কেমন? এখন যাও লক্ষ্মী দিদি আমার।’
বেশি খুশি হইয়া বলিল, ‘নিশ্চয় কিন্তু! তা না হলে আমি ঘুমুব না।’
‘আচ্ছা বেশ।’ বেবি প্ৰস্থান করিলে কালীগতি বলিলেন, ‘এইমাত্র থানা থেকে খবর নিয়ে লোক ফিরে এল–মাস্টারের কোনো সন্ধানই পাওয়া যায়নি।’
‘ও’ ব্যোমকেশ একটু থামিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘অনাদি বলে কোনো কর্মচারী আছে কি?’
‘আছে। অনাদি জমিদার বাড়ির সরকার।’ বলিয়া কালীগতি উৎসুক নেত্ৰে তাহার পানে চাহিলেন।
ব্যোমকেশ যেন একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘তাকে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না। সে কি আমলাদের পাড়াতেই থাকে?’
কালীগতি বলিলেন, ‘না। সে বহুকালের পুরনো চাকর। বাড়ির পিছন দিকে আস্তাবলের লাগাও কতকগুলো ঘর আছে, সেই ঘরগুলো নিয়ে সে থাকে।’
‘একলা থাকে?’
‘না, তার এক বিধবা মেয়ে আর স্ত্রী আছে। মেয়েটি কদিন থেকে অসুখে ভুগছে; অনাদিকে বললুম কবিরাজ ডাকো, তা সে রাজী নয়। বললে, আপনি সেরে যাবে।–কেন বলুন দেখি?’
‘না–কিছু নয়। কাছে পিঠে করা থাকে তাই জানতে চাই। অন্যান্য আমলারা বুঝি হাতার বাইরে থাকে?’
‘হ্যাঁ, তাদের জন্যে একটু দূরে বাসা তৈরি করিয়া দেওয়া হয়েছে—সবসুদ্ধ সাত-আট ঘর আমলা আছে। শহর থেকে যাতায়াত করলে সুবিধা হয় না, ভাই কর্তার আমলেই তাদের জন্যে একটা পাড়া বসানো হয়েছিল।’
‘শহর এখান থেকে কতদূর?’
‘মাইল পাঁচেক হবে। সামনের রাস্তাটা সিধা পুব দিকে শহরে গিয়েছে।’
এই সময় হিমাংশুবাবু বাড়ির ভিতর হইতে আসিয়া সহাস্যমুখে বলিলেন, ‘আসুন ব্যোমকেশবাবু্, আমার অস্ত্রাগার আপনাদের দেখাই।’
আমরা সাগ্রহে তাঁহার অনুসরণ করিলাম। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছিল, দেওয়ান আহিক করিবার সময় উপস্থিত বলিয়া খড়ম পায়ে অন্য দিকে প্রস্থান করিলেন।
হিমাংশুবাবু একটি মাঝারি আয়তনের ঘরে আমাদের লইয়া গেলেন। ঘরের মধ্যস্থলে টেবিলের উপর উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছিল। দেখিলাম, মেঝোয় বাঘ ভালুক ও হরিণের চামড়া বিছানো রহিয়াছে; দেওয়ালের ধারে ধারে কয়েকটি আলমারি সাজানো। হিমাংশুবাবু একে একে আলমারিগুলি খুলিয়া দেখাইলেন, নানাবিধ বন্দুক পিস্তল ও রাইফেলে আলমারিগুলি ঠাসা। এই হিংস্ৰ অস্ত্রগুলির প্রতি লোকটির অদ্ভুত স্নেহ দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। প্রত্যেকটির গুণাগুণ-কোনটির দ্বারা কবে কোন জন্তু বধ করিয়াছেন, কাহার পাল্লা কতখানি, কোন রাইফেলের গুলি বামদিকে ঈষৎ প্রক্ষিপ্ত হয়-এ সমস্ত তাঁহার নখদর্পণে। এই অস্ত্রগুলি তিনি প্ৰাণান্তেও কাহাকেও ছুইতে দেন না; পরিষ্কার করা, তেল মাখানো সবই নিজে করেন।
অস্ত্ৰ দেখা শেষ হইলে আমরা সেই ঘরেই বসিয়া গল্পগুজব আরম্ভ করিলাম। নানা বিষয়ের কথাবাত হইল। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একই মানুষকে এত বিভিন্ন রূপে দেখা যায় যে তাহার চরিত্র সম্বন্ধে একটা অভ্রান্ত ধারণা করিয়া লওয়া কঠিন হইয়া পড়ে। কিন্তু কাচিৎ স্বভাবছদ্মবেশী মানুষের মন অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে আত্মপরিচয় দিয়া ফেলে। এই ঘরে বসিয়া আয়াসহীন অনাড়ম্বর আলোচনার ভিতর দিয়া হিমাংশুবাবুর চিত্তটিও যেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ধরা দিল। লোকটি যে অতিশয় সরল চিত্ত-মনটিও তাঁহার বন্দুকের গুলির মত একান্ত সিধা পথে চলে, এ বিষয়ে অন্তত আমার মনে কোনো সন্দেহ রহিল না।
আমাদের সঞ্চরমান আলোচনা নানা পথ ঘুরিয়া কখন অজ্ঞাতসারে বিষয় সম্পত্তি পরিচালনা, দেশের জমিদারের অবস্থা ইত্যাদি প্রসঙ্গের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছিল। হিমাংশুবাবু এই সূত্রে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলিলেন। প্রজাদের সঙ্গে গত কয়েক বৎসর ধরিয়া নিয়ত সঙঘর্ষে তাঁহার মন তিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। জমিদারীর আয় প্ৰায় বন্ধ হইয়া গিয়াছে অথচ মামলা মোকদ্দমায় খরচের অন্ত নাই; ফলে, এই কয় বছরে ঋণের মাত্রা প্ৰায় লক্ষের কোঠায় ঠেকিয়াছে। নিজের বিষয় সম্পত্তির সম্বন্ধে এই সব গুহ্য কথা তিনি অকপটে প্রকাশ করিলেন। দেখিলাম, জমিদারী সংক্রান্ত আঁশান্তি তাঁহাকে বিষয় সম্পত্তির প্রতি আরো বিতৃষ্ণ করিয়া তুলিয়াছে। বিপদের গুরুত্ব অনভিজ্ঞতাবশত ঠিক বুঝিতে পারিতেছেন না, তাই মাঝে মাঝে অনির্দিষ্ট আতঙ্কে মন শঙ্কিত হইয়া উঠে; তখন সেই শঙ্কাকে তাড়াইবার জন্য প্রিয় ব্যসন শিকারের প্রতি আরো আগ্রহে ঝুঁকিয়া পড়েন। তাঁহার মনের অবস্থা বর্তমানে এইরূপ।