ছলনার ছন্দ

বললাম।—’থাকলে কি ধর্মশালায় আসি? কিন্তু এখানেও দেখছি জায়গা নেই। হোটেলের খরচ দিতে পারব না। তাই ভাবছি কী করি।’

গঙ্গাপদ বলল–‘দেখুন‌, আমার একটা প্রস্তাব আছে। কলকাতায় আমি থাকি‌, দক্ষিণ কলকাতায় আমার বাসা আছে। আমি মাসখানেকের জন্যে বাইরে যাচ্ছি‌, বাসাটা খালি পড়ে থাকবে। তা আপনি যদি আমার বাসায় থাকেন আপনারও সুবিধে আমারও সুবিধে। আমার একটা ঠিকে চাকর আছে‌, সে আপনার দেখাশোনা করবে‌, কোনো কষ্ট হবে না।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম।—’আমার মত একজন অচেনা লোকের হাতে আপনি বাসা ছেড়ে দেবেন!’

গঙ্গাপদ একটু হেসে বলল–‘তাহলে চমক লাগার কথাটা বলি। স্টেশনে আপনাকে দেখে মনে হয়েছিল। আপনি আমার ভাই দুগাপদ। তারপর ভুল বুঝতে পারলাম। দুগাপদ দু’ বছর আগে নিরুদেশ হয়ে গিয়েছিল‌, বোধ হয় সন্ন্যাসী হয়ে গেছে। আপনার সঙ্গে তার চেহারার খুব মিল আছে। তাই-মানে—আপনার প্রতি আমার একটু-ইয়ে—। আপনি যদি আমার বাসায় থাকেন আমি খুব নিশ্চিন্ত হব।’

আমার ভাগ্যে এমন যোগাযোগ ঘটবে স্বপ্নেও ভাবিনি। খুশি হয়ে রাজী হয়ে গেলাম।

গঙ্গাপদ আমাকে ট্যাক্সিতে তুলে তার বাসায় নিয়ে গেল। ছোট রাস্তায় ছোট বাড়ির দোতলায় একটি মাঝারি গোছের ঘর‌, ঘরে তক্তপোশের ওপর বিছানা‌, দেয়ালে আলমারি‌, দু’ একটা বাক্স সুটকেস। আর কিছু নেই।

হিন্দুস্থানী চাকরাটা উপস্থিত ছিল। তার নাম রামচতুর। গঙ্গাপদ তাকে পয়সা দিল দোকান থেকে চা জলখাবার আনতে। সে চলে গেলে গঙ্গাপদ রাস্তার দিকের জানলাটা খুলে দিয়ে তক্তপোশে এসে বসল‌, বলল–‘বসুন‌, আপনার সঙ্গে আরো কিছু কথা আছে।’

আমিও তক্তপোশে বসলাম। গঙ্গাপদ বলল—’আমার বাড়িওয়ালা কাশীপুরে থাকে‌, লোকটা ভাল নয়। সে যদি জানতে পারে। আমি অন্য কাউকে ঘরে বসিয়ে একমাসের জন্য বাইরে গেছি। তাহলে হাঙ্গামা বাধাতে পারে। তাই আপনাকে একটি কাজ করতে হবে। যদি কেউ আপনার নাম জিজ্ঞেস করে‌, আপনি বলবেন–গঙ্গাপদ চৌধুরী। লোকে ভাববে। আমি দাড়ি কামিয়ে ফেলেছি।’

শুনে আমার খুব মজা লাগল‌, বললাম–’বেশ তো‌, এ আর বেশি কথা কি?’

তারপর রামচতুর চা জলখাবার নিয়ে এল; গঙ্গাপদ আমাকে জলযোগ করিয়ে উঠে পড়ল‌, বলল— আচ্ছা‌, এবার তাহলে আমি চলি। আমার জিনিসপত্র ঘরে রইল। নিশ্চিন্ত মনে বাস করুন! নমস্কার।’

দোর পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গাপদ ফিরে এল‌, বলল–’একটা কথা বলা হয়নি। যখন ঘরে থাকবেন, মাঝে মাঝে জানলা খুলে রাস্তার দিকে তাকাবেন; লক্ষ্য করবেন রাস্তা দিয়ে লাল কোট পরা কোনো লোক যায় কিনা। যদি দেখতে পান‌, তারিখ আর সময়টা লিখে রাখবেন। কেমন?

‘আচ্ছা।’

গঙ্গাপদ চলে গেল। আমার সন্দেহ হলো তার মাথায় ছিট আছে। কিন্তু থাকুক ছিট‌, লোকটা ভাল। আমি বেশ আরামে রইলাম। রামচতুর আমার সেবা করে। আমি সকাল বিকেল এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াই‌, দুপুরে আর রাত্রে ঘরে থাকি। মাঝে মাঝে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি‌, রাস্তা দিয়ে লাল কোট পরা কেউ যাচ্ছে কিনা। লাল কোট পরে কলকাতার রাস্তায় কেউ ঘুরে বেড়াবে এ যেন ভাবাই যায় না। তবু গঙ্গাপদ যখন বলেছে‌, হবেও বা।

হগুপ্তাখানেক বেশ আরামে কেটে গেল।

আজ সকালে খবরের কাগজের অফিসে গেছলাম বোনের পাত্র সম্বন্ধে একটা বিজ্ঞাপন দিতে। ফিরে এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে তক্তপোশে শুলাম। রামচতুর চলে গেল।

ঘুম ভাঙল আন্দাজ পৌঁনে তিনটের সময়। বিছানা থেকে উঠে জানলা খুলে দিলাম। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছি‌, হঠাৎ মাথাটা ঝনঝনি করে উঠল‌, উলটে মেঝের ওপর পড়ে গেলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই‌, অসহ্য যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়লাম।

হাসপাতালে জ্ঞান হলো। মাথায় পাগড়ি বেঁধে শুয়ে আছি! কে নাকি আমার মাথা লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়েছিল‌, বন্দুকের গুলি আমার খুলির ওপর আঁচড় কেটে চলে গেছে।–‘কী ব্যাপার বলুন দেখি ব্যোমকেশবাবু?’

‘সেটা বুঝতে সময় লাগবে। আপনি এখন বিশ্রাম করুন।’ ব্যোমকেশ উঠে দাঁড়াল।

পরদিন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ রাখালবাবু ব্যোমকেশের বাড়িতে এলেন। ব্যোমকেশ তার অফিস ঘরে বসে। অলসভাবে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন পড়ছিল‌, রাখালবাবুকে একটি সিগারেট দিয়ে বলল— ‘নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’

রাখালবাবু সিগারেট ধরিয়ে বললেন–’রামচতুর পালিয়েছে।’

‘রামচতুর! ও—সেই চাকরাটা।’

‘হাঁ। কাল বিকেলবেল পুলিসকে খবর দিয়ে সেই যে গা-ঢাকা দিয়েছে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘সত্যিই রাম-চতুর। পুলিসের হাঙ্গামায় থাকতে চায় না। এতক্ষণ বোধ হয় বেহার প্রদেশে ফিরে গিয়ে ভুট্টা পুড়িয়ে খাচ্ছে। আর কিছু?’

‘বাড়িওয়ালাকে কাশীপুর থেকে খুঁজে বার করেছি। আজ সকালে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। অশোক মাইতিকে দেখে বলল‌, এই গঙ্গাপদ চৌধুরী; তারপর গলার আওয়াজ শুনে বলল‌, না গঙ্গাপদ নয়‌, কিন্তু চেহারার খুব মিল আছে।’

এই পর্যন্ত শুনে ব্যোমকেশ বলল— ‘গঙ্গাপদ চৌধুরীর সঙ্গে অশোক মাইতির চেহারার মিল আছে?’

রাখালবাবু বললেন–’হ্যাঁ‌, গঙ্গাপদ বলেছিল তার ভায়ের সঙ্গে মিল আছে‌, গঙ্গাপদ এবং তার ভায়ের চেহারা যদি এক রকম হয়–‘

‘গঙ্গাপদর দাড়িটা মেকি মনে হচ্ছে।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অশোক মাইতিকে এনে নিজের বাসায় ভুলল কেন? নিজের নামটাই বা তাকে দান করুল কেন? আসল কারণটা কী?’

ব্যোমকেশ কি-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল‌, তারপর অলস কণ্ঠে বলল— ‘চিন্তার কথা বটে। আসল গঙ্গাপদ বোধ করি এখনো নিরুদেশ।’

0 Shares