ছলনার ছন্দ

‘হ্যাঁ। তার ঘরের আলমারি থেকে কিছু কাগজপত্র পাওয়া গেছে‌, তা থেকে জানা যায়। সে কলকাতায় এক লোহার কারখানায় কাজ করে‌, সম্প্রতি একমাসের ছুটি নিয়ে অদৃশ্য হয়েছে।’

‘গুলিটা কোথা থেকে এসেছিল জানা গেছে?’

‘সামনের বাড়ি থেকে। রাস্তার ওপারে একটা পোড়ো বাড়ি কিছুদিন থেকে খালি পড়ে আছে‌, তার দোতলার জানলা থেকে কেউ গুলি ছুড়েছিল। পোড়ো বাড়ির ঘরের মধ্যে কয়েকটা তাজা আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে‌, কিন্তু করি আঙুলের ছাপ তা সনাক্ত করার উপায় নেই।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সংবাদগুলিকে একত্র করে মনের মধ্যে রোমন্থন করল‌, তারপর বলল—‘রহস্যটা কিছু পরিষ্কার হলো?’

রাখালবাবু সিগারেটে দুটো লম্বা টান দিয়ে সেটাকে অ্যাশ-ট্রের ওপর নিবিয়ে দিলেন‌, আস্তে আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে আরম্ভ করলেন–‘গঙ্গাপদ চৌধুরীর দাড়ি যে নকল দাড়ি তার একটা জোরালো প্রমাণ‌, তার বাড়িওয়ালা তার মুখে কখনো দাড়ি-গোঁফ দেখেনি; আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাহলে প্রশ্ন উঠছে‌, গঙ্গাপদ ছদ্মবেশে বেড়ায় কেন। একটা কারণ এই হতে পারে যে‌, সে ছদ্মবেশে কোনো গুরুতর অপরাধ করতে চায়। তারপর একদিন হাওড়া স্টেশনে সে অশোক মাইতিকে দেখতে পায়‌, নিজের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য দেখে তাকে ভুলিয়ে নিজের বাসায় এনে বসায়‌, তারপর নিজে গা-ঢাকা দেয়। হয়তো সে নিজেই সামনের বাড়ি থেকে অশোককে খুন করার চেষ্টা করেছিল‌, যাতে লোকে মনে করে যে‌, গঙ্গাপদই মরেছে। হয়তো এইভাবে সে জীবনবীমার টাকা সংগ্রহ করতে চেয়েছিল। যাই হোক‌, এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে এই যে‌, তার পরিচয় এবং বর্তমান ঠিকানা আমরা জানি না; সে অশোক মাইতিকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল কিনা তা নিশ্চয়ভাবে জানি না‌, কারণ তার কাগজপত্রের মধ্যে জীবনবীমার পলিসি পাওয়া যায়নি। এখন কর্তব্য কি?’

ব্যোমকেশ একটু ভেবে বলল— ‘মীরাটে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে?’

রাখালবাবু বললেন–‘অশোক মাইতিকে দিয়ে মীরাটে তার মা’র নামে টেলিগ্রাম করিয়েছি। এখনো জবাব আসেনি। কেন‌, আপনি কি অশোক মাইতিকে সন্দেহ করেন?’

‘অশোক মাইতিকে বড় বেশি ভাল মানুষ বলে মনে হয়। সে হয়তো সত্যি কথাই বলছে‌, কিন্তু তার কোনো সমর্থন নেই। রামচতুর সমর্থন করতে পারত‌, কিন্তু সে পালিয়েছে। —যাক‌, গঙ্গাপদ কোথায় কাজ করে?’

‘কলকাতার উপকণ্ঠে একটা লোহার কারখানা আছে সেইখানে।’ রাখালবাবু পকেট থেকে নোটবুক বার করেপ পড়লেন–‘Scrap Iron & Steel Factory Ltd.’

‘সেখানে খোঁজ নিলে কিছু খবর পাওয়া যেতে পারে।’

‘সেখানে যাব বলেই বেরিয়েছি। আপনি আসবেন সঙ্গে?’

‘যাব। বাড়িতে বেকার বসে থাকার চেয়ে ঘুরে বেড়ালে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।’

কলকাতার দক্ষিণ সীমানার বাইরে বিঘে দুই জমির ওপর লোহার কারখানা। জমির এধারে ওধারে কয়েকটা করোগেট টিনের উঁচু ছাউনি‌, তাদের ফাঁকে ফাঁকে এখানে ওখানে স্তুপীকৃত জং-ধরা ঝুনো পুরনো লোহা। চারিদিকে কমীদের তৎপরতা দেখে মনে হয় কারখানার কাজ চালু আছে। ফটকের পাশে একটি ছোট পাকা বাড়ি‌, এটি কোম্পানির অফিস।

রতনলাল কাপড়িয়া অফিস ঘরে ছিলেন। রতনলাল মাড়োয়ারী হলেও তিন পুরুষ ধরে বাংলাদেশে আছেন‌, প্রায় বাঙালী হয়ে গেছেন; পরিষ্কার বাংলা বলেন। দু’জনকে সামনে বসিয়ে পান সিগারেট দিলেন‌, বললেন—‘হুকুম করুন।’

রাখালবাবু একবার ব্যোমকেশের পানে তাকিয়ে প্রশ্ন আরম্ভ করলেন‌, ব্যোমকেশ চুপ করে বসে শুনতে লাগল।–

‘গঙ্গাপদ চৌধুরী এখানে কাজ করে?’

‘হ্যাঁ। উপস্থিত ছুটিতে আছে।’

‘সে কী কাজ করে?

ইলেকট্রিক ফার্নেসের মেল্টার।’

‘সে কাকে বলে?’

‘আজকাল ইলেকট্রিক আগুনে লোহা গলানো হয়। যে লোক এই কাজ জানে তাকে মেল্টার বলে। গঙ্গাপদ আমার সর্দার মেল্টার। সে ছুটিতে গেছে বলে আমার একটু অসুবিধে হয়েছে। তার অ্যাসিস্টেন্ট দু’জন আছে বটে‌, কোনো মতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। আমাদের দেশে ভাল মেল্টার বেশি নেই‌, যে দু’চারজন আছে‌, গঙ্গাপদ তাদের একজন।’

‘তাই নাকি! সে ছুটি নিল কেন?’

‘তার একমাস ছুটি পাওনা হয়েছিল। মনে হচ্ছে যেন বলেছিল ভারত ভ্বমণে যাবে; আজকাল সব স্পেশাল ট্রেন হয়েছে সারা দেশ ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়।’

‘হ্যাঁ। ওর আত্মীয়স্বজন কেউ আছে?’

‘বোধ হয়না। একলা থাকত।’

‘ওর স্বভাব-চরিত্র কেমন?’

‘খুব কাজের লোক। বুদ্ধিসুদ্ধি আছে। হাঁশিয়ার।’

রাখালবাবু ব্যোমকেশের পানে তাকালেন। ব্যোমকেশ যেন ঝিমিয়ে পড়েছিল‌, একটু সজাগ হয়ে বলল— ‘গঙ্গাপদর কোনো শত্ৰু আছে কিনা। আপনি জানেন?’

রতনলাল ভুরু তুললেন-‘শত্রু! কই‌, গঙ্গাপদর শক্র আছে এমন কথা তো কখনো শুনিনি-ওঃ!’

তিনি হঠাৎ হেসে উঠলেন–’একজনের সঙ্গে গঙ্গাপদর শক্রতা হয়েছিল‌, সে এখন জেলে।’

‘তিনি কে?’

‘তার নাম নরেশ মণ্ডল। তিন বছর আমার সর্দার মেল্টার ছিল‌, গঙ্গাপদ ছিল তার অ্যাসিস্টেন্ট। দু’জনের মধ্যে খিটিমিটি লেগে থাকত। নরেশ ছিল রাগী‌, আর গঙ্গাপদ মিটমিট বজ্জাত। কিন্তু দু’জনেই সমান কাজের লোক। আমি মজা দেখতাম। তারপর হঠাৎ একদিন নরেশ একজনকে খুন করে বসল। গঙ্গাপদ তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিল। নরেশের জেল হয়ে গেল।’

‘খুনের জন্যে জেল! কতদিনের মেয়াদ জানেন?’

‘ঠিক জানি না। চার পাঁচ বছর হবে। নরেশ জেলে যাবার পর গঙ্গাপদ সদার মেল্টার হয়ে বসল।’ বলে রতনলাল হো হো শব্দে হাসলেন।‌

ব্যোমকেশ হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল–’আপনাকে অনেক বিরক্ত করেছি‌, এবার উঠি। একটা কথা–গঙ্গাপদকে আপনি শেষবার দেখেছেন কবে?’

0 Shares