ছলনার ছন্দ

‘হয়েছে।’

‘গঙ্গাপদ চৌধুরীর পাত্তা পাওয়া যায়নি?’

‘না। ভারত ভ্রমণের যত স্পেশাল ট্রেন আছে তাদের অফিসে খোঁজ নিয়েছিলাম। কিন্তু গঙ্গাপদ চৌধুরী নামে কোনো যাত্রীর নাম নেই।’

‘হুঁ। হয়তো ছদ্মনামে গিয়েছে।’

‘কিংবা যায়নি। কলকাতাতেই কোথাও লুকিয়ে বসে আছে।’

‘তাও হতে পারে। আর কোনো নতুন খবর আছে?’

‘এইমাত্র মীরাট থেকে ‘তার’ এসেছে। অশোক মাইতি খাঁটি মীরাটের লোক। ওখানে কোনো জাল-জুচ্চুরি নেই।’

‘ভাল; আর কিছু।’

‘নতুন খবর আর কিছু নেই। এখন কর্তব্য কি বলুন!’

‘কর্তব্য কিছু ভেবে পাচ্ছি না। একটা কথা। নরেশের জেলের মেয়াদ এতদিনে ফুরিয়ে আসার কথা‌, সে জেল থেকে বেরিয়েছে কিনা খবর নিতে পোর?’

‘পারি। কাল সকালে খবর পাবেন।’

পরদিন বেলা ন’টার সময় রাখালবাবু ব্যোমকেশের কাছে এলেন। মুখ গম্ভীর। বললেন–‘ব্যাপার গুরুতর। দেড়মাস আগে নরেশ মণ্ডল জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। জেলে ভাল ছেলে সেজে ছিল তাই কিছু দিনের রেয়াত পেয়েছে।’

ব্যোমকেশ বলল–’হুঁ। জেল থেকে বেরিয়ে সে কোথায় গেছে সন্ধান পেয়েছ?’

‘তার পুরোনো বাসায় যায়নি। কারখানাতেও যায়নি‌, কাল রতনলাল কাপড়িয়ার মুখে তা জানতে পেরেছি। সুতরাং সে ডুব মেরেছে।’

ব্যোমকেশ একটু চুপ করে থেকে বলল–‘ব্যাপারটা এখন পরিষ্কার হচ্ছে। নরেশের মনে যদি পাপ না থাকবে তাহলে সে ডুব মারবে কেন? সে রতনলালের কাছে গিয়ে চাকরিটা আবার ফিরে পাবার চেষ্টা করত।’

‘আমারও তাই মনে হয়।’

‘গল্পটা এখন কালানুক্রমে সাজানো যেতে পারে।–নরেশ মণ্ডল রাগী এবং ঝগড়াটে‌, গঙ্গাপদ মিটমিটে শয়তান। দু’জনে এক কারখানায় কাজ করত; দু’জনের মধ্যে খিটিমিটি লেগেই থাকত। গঙ্গাপদর মতলব নরেশকে সরিয়ে নিজে তার জায়গায় বসবে। কিন্তু নরেশকে সরানো সহজ নয়‌, সে কাজের লোক।

‘হঠাৎ গঙ্গাপদ সুযোগ পেয়ে গেল। নরেশ রাস্তায় একটা ভিখিরিকে চড় মেরে শেষ করে দিল। আর যায় কোথায়! গঙ্গাপদ নরেশকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাবার জন্যে উঠে-পড়ে লাগল।

‘নরেশের কিন্তু ফাঁসি হলো না। সে দোষী সাব্যস্ত হলেও তার তিন বছর কারাদণ্ড হলো। গঙ্গাপদর পক্ষে একটা মন্দের ভাল‌, সে কারখানায় সদর মোল্টার হয়ে বসল। নরেশ জেলে গেল।

নিরেশ লোকটা শুধু বদমেজাজী নয়‌, সে মনের মধ্যে রাগ পুষে রাখে। জেলে যাবার সময় সে বোধ হয় প্রতিজ্ঞা করেছিল‌, গঙ্গাপদকে খুন করে প্রতিহিংসা সাধন করবে। তিন বছর ধরে সে এই প্রতিহিংসার আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে।

‘গঙ্গাপদ জানত নরেশের তিন বছরের জেল হয়েছে‌, সে তঙ্কেতকে ছিল। তাই নরেশ যখন মেয়াদ ফুরবার আগেই জেল থেকে বেরুল‌, গঙ্গাপদ জানতে পারল। তার প্রাণে ভয় ঢুকল। হয়তো সে দেখেছিল নরেশ তার বাসার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিংবা সামনের পোড়ো বাড়ি থেকে উকিঝুকি মারছে। গঙ্গাপদ ঠিক করল কিছুদিনের জন্যে বাসা থেকে উধাও হবে।

‘সে কারখানা থেকে একমাসের ছুটি নিল এবং একটা দাড়ি যোগাড় করে তাই পরে ঘুরে বেড়াতে লাগল‌, যাতে নরেশ তাকে দেখলেও চিনতে না পারে। গঙ্গাপদ বোধহয় সত্যিই ভারত ভ্বমণে যাবার মতলব করেছিল‌, তারপর হঠাৎ একদিন হাওড়া স্টেশনে অশোক মাইতির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে দেখল। অশোক মাইতির চেহারা অনেকটা তার নিজের মত।

‘গঙ্গাপদ লোকটা মহা ধূর্ত। তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল‌, অশোক মাইতিকে যদি কোনোমতে নিজের বাসায় এনে তুলতে পারে তাহলে নরেশ ভুল করে তাকেই খুন করবে এবং ভাববে‌, গঙ্গাপদকে খুন করেছে। গঙ্গাপদ নিরাপদ হবে‌, তাকে আর প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হবে না। চাকরিটা অবশ্য যাবে; কিন্তু প্ৰাণ আগে‌, না চাকরি আগে? গঙ্গাপদ নিশ্চয় বুঝেছিল যে‌, নরেশ তাকে সামনের জানলা থেকে গুলি করে মারবে।

‘এবার নরেশের দিকটা ভেবে দেখা যাক। নরেশ জেল থেকে বেরিয়ে একটা পিস্তল যোগাড় করেছিল। পুরোনো বাসায় ফিরে যাবার কোনো মনে হয় না‌, সে অন্য কোথাও আড়া গেড়েছিল এবং গঙ্গাপদর বাসার সামনে পোড়ো বাড়িটায় যাতায়াত করেছিল। তার বোধ হয় মতলব ছিল গঙ্গাপদ কখনো তার জানলা খুলে দাঁড়ালে সে রাস্তার ওপর থেকে তাকে গুলি করে মারবে‌, তারপর কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে। গঙ্গাপদ খুন হবার পর কলকাতা শহর আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়‌, পুলিস তাকে সন্দেহ করতে পারে।

‘যাহোক‌, গঙ্গাপদ অশোক মাইতিকে নিজের বাসায় বসিয়ে লোপাট হলো। অশোক মাইতিকে উপদেশ দিয়ে গেল‌, সে যেন মাঝে মাঝে জািনলা খুলে লক্ষ্য করে‌, রাস্তা দিয়ে লাল কোট পরা কেউ যায় কি না। লাল কোট পরা মানুষটা নিছক কল্পনা; আসল উদ্দেশ্য অশোক মাইতি জানিলা খুলে দাঁড়াবে এবং নরেশ সামনের জানলা থেকে তাকে গুলি করবে।

‘সবই ঠিক হয়েছিল। কিন্তু একটা চুক হয়ে গেল; অশোক মাইতি আহত হলো‌, মরাল না। সে পুলিসকে সব ঘটনা বলল। এখন গঙ্গাপদ আর নরেশ দু’জনের অবস্থাই সমান‌, ওরা কেউ আর আত্মপ্রকাশ করতে পারে না। খবরের কাগজে সংবাদ ছাপা হয়েছে‌, দু’জনকেই পুলিস খুঁজে বেড়াচ্ছে।

নিরেশ অবশ্য আইনত অপরাধী‌, সে খুন করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গঙ্গাপদ লোকটা মহা পাষণ্ড; জেনেশুনে সে একজন নিরীহ লোককে অনিবাৰ্য মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিন্তু সে যদি ধরাও পড়ে তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’

ব্যোমকেশ চুপ করল। রাখালবাবুও নীরবে কিছুক্ষণ টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে আকিজোক কেটে বললেন–‘তা যেন হলো। কিন্তু যাকে আইনত শাস্তি দেওয়া যাবে তাকে ধরবার উপায়। কি বলুন!’

0 Shares