ছলনার ছন্দ

আবার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ব্যোমকেশ বলল–’একমাত্র উপায়–বিজ্ঞাপন।’

‘বিজ্ঞাপন!’

‘হ্যাঁ।–পুকুরে ছিপ ফেলে বসে থাকা। মাছ যদি টোপ গেলে তবেই তাকে ধরা যাবে।’

তিন দিন পরে কলকাতার দুইটি প্রধান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বেরুল :

বম্বে স্টীল ফাউন্ড্রি লিমিটেড–

আমাদের বম্বের কারখানার জন্য অভিজ্ঞ ইলেকট্রিক মেল্টার চাই।

বেতন-৭০০-২৫-১০০০্‌।

প্রশংসাপত্র সহ দেখা করুন।

গড়িয়াহাট বাজারের কাছে রাস্তার উপর একটি ঘর‌, তার মাথার উপর সাইনবোর্ড ঝুলছে—

বম্বে স্টীল ফাউন্ড্রি লিমিটেড (ব্রাঞ্চ অফিস)।

ঘরের মধ্যে একটি টেবিলের সামনে রাখালবাবু বসে আছেন‌, তাঁর পরিধানে সাদা কাপড়চোপড়। তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে নথিপত্র দেখছেন। অদূরে অন্য একটি ছোট টেবিলে ব্যোমকেশ টাইপরাইটার নিয়ে বসেছে। ঘরের দোরের কাছে তকমা-আঁটা একজন বেয়ারা। আর যারা আছে তারা প্রচ্ছন্নভাবে এদিকে ওদিকে আছে‌, তাদের দেখা যায় না।

প্রথম দিন ব্যোমকেশ ও রাখালবাবু বেলা দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অফিস ঘরে বসে রইলেন‌, কোনো চাকরি-প্ৰাৰ্থ দেখা করতে এল না। পাঁচটার সময় ঘরের দোরে তালা লাগাতে লাগাতে রাখালবাবু বললেন– ‘বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে হবে।’

পরদিন একটা লোক দেখা করতে এল। রোগা-পাটকা লোক‌, এক চড়ে মানুষ মেরে ফেলবে এমন চেহারা নয়। তার প্রশংসাপত্র দেখে জানা গেল‌, তার নাম প্রফুল্ল দে‌, সে একজন ইলেকট্রিকের মিস্ত্রী। ইলেকট্রিক মেল্টারের কাজ সে কখনো করেনি বটে‌, কিন্তু সুযোগ পেলে চেষ্টা করতে রাজী আছে। রাখালবাবু তার নাম-ধাম লিখে নিয়ে মিষ্টি কথায় বিদায় দিলেন।

তৃতীয় দিন তৃতীয় প্রহরে একটি লোক দেখা করতে এল। তাকে দেখেই রাখালবাবুর শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে উঠল। মজবুত হাড়-চওড়া শরীর‌, গায়ের রং কালো‌, চোখের কোণে একটু রক্তিমাভা; গায়ে খাকি কোট‌, মাথায় চুল ক্রু-কাট করে ছাঁটা। সে সতর্কভাবে এদিক ওদিক চাইতে চাইতে ঘরে ঢুকল। রাখালবাবুর টেবিলের সামনে দড়িয়ে ধরা-ধরা গলায় বলল–’বিজ্ঞাপন দেখে এসেছি।’

‘বসুন।’

লোকটি সন্তপণে সামনের চেয়ারে বসল‌, একবার ব্যোমকেশের দিকে তীক্ষ্ণ সতর্ক চোখ ফেরাল। রাখালবাবু সহজ সুরে বললেন— ‘ইলেকট্রিক মেল্টারের কাজের জন্য এসেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘সাটিফিকেট এনেছেন?’

লোকটি খানিক চুপ করে থেকে বলল–’আমার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেছে। তিন বছর অসুখে ভুগেছি‌, কাজ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। তারপর–সাটিফিকেট হারিয়ে ফেলেছি।’

‘আগে কোথায় কাজ করতেন?’

‘নাগপুরে একটা আয়রন ফাউন্ড্রি আছে‌, সেখানে কাজ করতাম।–দেখুন‌, আমি সত্যিই ইলেকট্রিক মেল্টারের কাজ জানি। বিশ্বাস না হয় আমি নিজের খরচে বম্বে গিয়ে তা প্রমাণ করে দিতে পারি।’

রাখালবাবু লোকটিকে ভাল করে দেখলেন‌, তারপর বললেন–’সে কথা মন্দ নয়। কিন্তু আমাদের এটা ব্রাঞ্চ অফিস‌, সবেমাত্র খোলা হয়েছে। আমি নিজের দায়িত্বে কিছু করতে পারি না। তবে এক কাজ করা যেতে পারে। আমি আজ বম্বেতে হেড অফিসে ‘তার করব‌, কাল বিকেল নাগাদ উত্তর পাব। আপনি কাল এই সময়ে যদি আসেন–’

‘আসব‌, নিশ্চয় আসব।’ লোকটি উঠে দাঁড়াল।

রাখালবাবু ব্যোমকেশের দিকে তাকিয়ে বললেন–‘বক্সী‌, ভদ্রলোকের নাম আর ঠিকানা লিখে নাও।‘

ব্যোমকেশ বলল–’আজ্ঞে।’

নাম আর ঠিকানা দিতে হবে শুনে লোকটি একটু থতিয়ে গেল‌, তারপর বলল–’আমার নাম নৃসিংহ মল্লিক। ঠিকানা ১৭ নম্বর কুঞ্জ মিস্ত্রী লেন।’

ব্যোমকেশ নাম ঠিকানা লিখে নিল। ইতিমধ্যে রাখালবাবু টেবিলের তলায় একটি গুপ্ত বোতাম টিপেছিলেন‌, বাইরে তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের কাছে খবর গিয়েছিল যে‌, ঘর থেকে যে ব্যক্তি বেরুবে তাকে অনুসরণ করতে হবে। রাখালবাবু নিঃসংশয়ে বুঝেছিলেন যে‌, এই ব্যক্তিই নরেশ মণ্ডল। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তার করার আগে তার বাসার ঠিকানা পাকিভাবে জানা দরকার। সেখানে বন্দুক পাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু কিছুই প্রয়োজন হলো না।

নরেশ দোরের দিকে পা বাড়িয়েছে এমন সময় আর একটি লোক ঘরে প্রবেশ করল। নবাগতকে চিনতে তিলমাত্র বিলম্ব হয় না‌, একেবারে অশোক মাইতির যমজ ভাই। সুতরাং গঙ্গাপদ চৌধুরী। আজ আর তার মুখে দাড়ি নেই।

গঙ্গাপদ নরেশকে দেখার আগেই নরেশ গঙ্গাপদকে দেখেছিল; বাঘের মত চাপা গর্জন তার গলা থেকে বেরিয়ে এল‌, তারপর সে গঙ্গাপদর ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল। দুহাতে তার গলা টিপে ধরে ঝাঁকানি দিতে দিতে বলতে লাগল— ‘পেয়েছি তোকে! শালা— শূয়ার কা বাচ্চা— আর যাবি কোথায়!’

রাখালবাবু দ্রুত পকেট থেকে বাঁশি বার করে বাজালেন। আরদালি এবং আর যেসব পুলিসের লোক আনাচে-কানাচে ছিল তারা ছুটে এল। গলা টিপুনি খেয়ে গঙ্গাপদর তখন জিভ বেরিয়ে পড়েছে। সকলে মিলে টানাটানি করে নরেশ আর গঙ্গাপদকে আলাদা করল। রাখালবাবু নরেশের হাতে হাতকড়া পর্যালেন। বললেন— নরেশ মণ্ডল‌, গঙ্গাপদ চৌধুরীকে খুনের চেষ্টার অপরাধে তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।’

নরেশ মণ্ডল রাখালবাবুর কথা শুনতেই পেল না‌, গঙ্গাপদর পানে আরক্ত চক্ষু মেলে গজরাতে লাগল–‘হারামজাদা বেইমান‌, তোর বুক চিরে রক্ত পান করব–’

ব্যোমকেশ এতক্ষণ বসেছিল‌, চেয়ার ছেড়ে ওঠেনি। সে এখন টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট ধরাল।

রাখালবাবু তাঁর একজন সহকর্মীকে বললেন–‘ধীরেন‌, এই নাও নরেশ মণ্ডলের ঠিকানা। ওর ঘর খানাতল্লাশ কর। সম্ভবত একটা রিভলবার কিংবা পিস্তল পাবে।—আমরা এদের দু’জনকে লক-আপ-এ নিয়ে যাচ্ছি।’

0 Shares