ঘরে প্রবেশ করিতে করিতে শুনিতে পাইলাম, মুরলীধর পেঁচালো সুরে বলিতেছে, যার ধন। তার ধন নয়, নেপোয় মারে দৈ! মণিলালকে দুর্গ দেওয়া হবে কেন? আমি কি ভেসে এসেছি? দুৰ্গ আমি নেব।’
বংশীধর অমনি বলিয়া উঠিল, ‘তুমি নেবে কেন? আমার দাবি আগে, দুৰ্গ আমি নেব। আমি ওটা মেরামত করিয়ে ওখানে বাস করব।’
রামকিশোর বারুদের মত ফাটিয়া পড়িলেন, ‘খবরদার! আমার মুখের ওপর যে কথা বলবে জুতিয়ে তার মুখ ছিঁড়ে দেব। আমার সম্পত্তি আমি যাকে ইচ্ছে দিয়ে যাব। মণিলালকে আমি সর্বস্ব দিয়ে যাব, তোমাদের তাতে কি! বেয়াদব কোথাকার।’
মণিলাল শান্তস্বরে বলিল, ‘আমি তো কিছুই চাইনি–।’
মুরলীধর মুখের একটা ভঙ্গী করিয়া বলিল, ‘না কিছুই চাওনি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাবাকে বশ করেছ। মিট্মিটে ডান–’
রামকিশোর আবার ফাটিয়া পড়িবার উপক্ৰম করিতেছিলেন, ডাক্তার ঘটক হাত তুলিয়া বলিল, ‘রামকিশোরবাবু্, আপনি বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, আপনার শরীরের পক্ষে ওটা ভাল নয়। আজ বরং কথাবার্তা বন্ধ থাক, আর একদিন হবে।’
রামকিশোরবাবু ঈষৎ সংযত হইয়া বলিলেন, না ডাক্তার, এ ব্যাপার টাঙিয়ে রাখা চলবে না। আজ আছি কাল নেই, আমি সব হাঙ্গামা চুকিয়ে রাখতে চাই। হিমাংশুবাবু্, আমি আমার সম্পত্তির কি রকম ব্যবস্থা করতে চাই আপনি শুনেছেন; আর বেশি আলোচনার দরকার নেই। আপনি দলিলপত্র তৈরি করতে আরম্ভ করে দিন। যত শীগগির দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে যায় ততাই ভাল।’
‘বেশ, তাই হবে। আজ তাহলে ওঠা যাক।।’ হিমাংশুবাবু গাত্ৰোত্থান করিলেন। এতক্ষণে সকলের নজর পড়িল যে আমরা তিনজন ন যযৌ ন তন্থেী ভাবে দ্বারের নিকটে দাঁড়াইয়া আছি। রামকিশোর ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন, ‘কে?’
পাণ্ডে আগাইয়া গিয়া বলিলেন, ‘আমি। আমার দু’টি কলকাতার বন্ধু বেড়াতে এসেছেন, তাঁদের দুর্গ দেখাতে এনেছিলাম।’ বলিয়া বোমকেশের ও আমার নামোল্লেখ করিলেন।
রামকিশোর সমােদর সহকারে বলিলেন, ‘আসুন, আসুন। বসতে আজ্ঞা হোক।’ কিন্তু তিনি ব্যোমকেশের নাম পূর্বে শুনিয়াছেন বলিয়া মনে হইল না।
বংশীধর ও মুরলীধর উঠিয়া গেল। ডাক্তার ঘটক আমাদের দেখিয়া একটু বিস্মিত ও অপ্ৰতিভ হইল, তারপর হাত তুলিয়া নমস্কার করিল। ডাক্তারের সঙ্গে দু’একটা কথা হইবার পর সে উকিল হিমাংশুবাবুকে লইয়া প্ৰস্থান করিল। ঘরের মধ্যে রহিয়া গেলাম আমরা তিনজন এবং ও-পক্ষে রামকিশোরবাবু্, নায়েব চাঁদমোহন এবং জামাই মণিলাল।
রামকিশোর হাকিলেন, ‘ওরে কে আছিস, আলো দিয়ে যা, চা তৈরি কর।’ চাঁদমোহন বলিলেন, ‘আমি দেখছি—’ তিনি উঠিয়া গেলেন। চাঁদমোহনের চেহারা কালো এবং চিমশে কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে ধূৰ্ততা ভরা। তিনি যাইবার সময় ব্যোমকেশের প্রতি একটি দীর্ঘ-গভীর অপাঙ্গদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া গেলেন।
দুই চারিটি সৌজন্যমূলক বাক্যালাপ হইল। বাহিরের লোকের সহিত রামকিশোরের ব্যবহার বেশ মিষ্ট ও অমায়িক। তারপর ব্যোমকেশ বলিল, ‘শুনলাম ঈশানবাবু এখানে এসে সর্পাঘাতে মারা গেছেন। আমি তাঁকে চিনতাম, একসময় তাঁর ছাত্র ছিলাম।’
‘তাই নাকি!’ রামকিশোর চকিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিলেন, ‘আমার বড় ছেলেও—। কি বলে, ঈশান আমার প্রাণের বন্ধু ছিল, ছেলেবেলার বন্ধু। সে আমার বাড়িতে এসে অপঘাতে মারা গেল, এ লজ্জা আমি জীবনে ভুলব না।’ তাঁহার কথার ভাবে মনে হইল, সপাঘাতে মৃত্যু সম্বন্ধে যে সন্দেহ আছে তাহা তিনি জানেন না।
ব্যোমকেশ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিল, ‘বড়ই দুঃখের বিষয়। তিনি আপনার দাদারও বন্ধু ছিলেন?’
রামকিশোর ক্ষণেক নীরব থাকিয়া যেন একটু বেশি ঝোঁক দিয়া বলিলেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু দাদা প্ৰায় ত্ৰিশ বছর হল মারা গেছেন।’
‘ও-তাহলে কর্তমানে আপনার সঙ্গেই তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল।–আচ্ছা, তিনি এবার এখানে আসার আগে এ বাড়ির কে কে তাঁকে চিনতেন? আপনি চিনতেন। আর-?’
‘আর আমার নায়েব চাঁদমোহন চিনতেন।’
‘আপনার ড্রাইভার তো পুরোনো লোক, সে চিনত না?’
‘হ্যাঁ, বুলাকিলাল চিনত।’
‘আর, আপনার বড় ছেলেও বোধহয় তাঁর ছাত্র ছিলেন?’
গলাটা পরিষ্কার করিয়া রামকিশোর বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’
এই বাক্যালাপ যখন চলিতেছিল তখন জামাই মণিলালকে লক্ষ্য করিলম। ভোজনরত মানুষের পাতের কাছে বসিয়া পোষা বিড়াল যেমন একবার পাতের দিকে একবার মুখের দিকে পৰ্যায়ক্রমে চক্ষু সঞ্চালন করে, মণিলাল তেমনি কথা বলার পর্যয়ক্রমে ব্যোমকেশ ও রামকিশোরের দিকে দৃষ্টি ফিরাইতেছে। তাহার মুখের ভাব আধা-অন্ধকারে ভাল ধরা গেল না, কিন্তু সে যে একাগ্রমনে বাক্যালাপ শুনিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঈশানবাবুর মুঠিতে একটি মোহর পাওয়া গিয়েছিল। সেটি কোথা থেকে এল বলতে পারেন?
রামকিশোর মাথা নাড়িয়া বলিলেন, না। ভারি আশ্চর্য ব্যাপার। ঈশানের আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। অন্তত মোহর নিয়ে বেড়াবার মত ছিল না।’
‘দুর্গে কোথাও কুড়িয়ে পাওয়া সম্ভব নয় কি?’
রামকিশোর বিবেচনা করিয়া বলিলেন, ‘সম্ভব। কারণ আমার পূর্বপুরুষদের অনেক সোনা-দানা ঐ দুর্গে সঞ্চিত ছিল। সিপাহীরা যখন লুঠ করতে আসে তখন এক-আধটা মোহর এদিকে ওদিকে ছিটকে পড়া বিচিত্র নয়। তা যদি হয় তাহলে ও মোহর আমার সম্পত্তি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার সম্পত্তি হলে ঈশানবাবু মোহরটি আপনাকে ফেরত দিতেন না কি? আমি যতদূর জানি, পরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করবার লোক তিনি ছিলেন না।’