দুর্গরহস্য

‘তা ঠিক। কিন্তু অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়। তা ছাড়া‌, মোহরটা কুড়িয়ে পাবার সময়েই হয়তো তাকে সাপে কামড়েছিল। বেচারা সময় পায়নি।’

এই সময় একজন ভৃত্য কেরোসিনের ল্যাম্প আনিয়া টেবিলের উপর রাখিল‌, অন্য একজন ভৃত্য চা এবং জলখাবারের ট্ৰে লইয়া আমাদের সম্মুখে ধরল। আমরা সবিনয়ে জলখাবার প্রত্যাখ্যান করিয়া চায়ের পেয়ালা তুলিয়া লইলাম।

চায়ে চুমুক দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখানে বিদ্যুৎ বাতির ব্যবস্থা নেই। ঈশানবাবুও নিশ্চয় রাত্রে কেরোসিনের লণ্ঠন ব্যাবহার করতেন?’

রামকিশোর বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ। তবে মৃত্যুর হস্তাখানেক আগে সে একবার আমার কাছ থেকে একটা ইলেকট্রিক টর্চ চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর পর আর সব জিনিসই পাওয়া গেল কেবল ঐ টৰ্চটা পাওয়া যায়নি।’

‘তাই নাকি! কোথায় গেল টাৰ্চটা?’

এতক্ষণে মণিলাল কথা কহিল‌, গম্ভীর মুখে বলিল‌, ‘আমার বিশ্বাস ঐ ঘটনার পরদিন সকালবেলা গোলমালে কেউ টৰ্চটা সরিয়েছে।’

পাণ্ডে প্রশ্ন করিলেন‌, ‘কে সরাতে পারে? কারুর ওপর সন্দেহ হয়?’

মণিলাল উত্তর দিবার জন্য মুখ খুলিয়াছিল‌, রামকিশোর মাঝখানে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘না না‌, মণি‌, ও তোমার ভুল ধারণা। রমাপতি নেয়নি‌, নিলে স্বীকার করত।’

মণিলাল আর কথা কহিল না‌, ঠোঁট চাপিয়া বসিয়া রহিল। বুঝিলাম‌, টর্চ হারানোর প্রসঙ্গ পূর্বে আলোচিত হইয়াছে এবং মণিলালের সন্দেহ মাস্টার রমাপতির উপর। একটা ক্ষুদ্র পরিবারিক মতান্তর ও অস্বাচ্ছন্দ্যের ইঙ্গিত পাওয়া গেল।

অতঃপর চা শেষ করিয়া আমরা উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এই সূত্রে আপনার সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য হল। বড় সুন্দর জায়গায় বাড়ি করেছেন। এখানে একবার এলে আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।’

রামকিশোর আনন্দিত হইয়া বলিলেন‌, ‘বেশ তো‌, দুদিন না হয় থেকে যান না। দুদিন পরে কিন্তু প্ৰাণ পালাই-পালাই করবে। আমাদের অভ্যোস হয়ে গেছে তাই থাকতে পারি।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনার নিমন্ত্রণ মনে রাখব। কিন্তু যদি আসি‌, ঐ দুর্গে থাকতে দিতে হবে। ক্ষুধিত পাষাণের মত আপনার দুর্গটা আমাকে চেপে ধরেছে।’

রামকিশোর বিরসমুখে বলিলেন‌, ‘দুর্গে আর কাউকে থাকতে দিতে সাহস হয় না। যা হোক‌, যদি সত্যিই আসেন তখন দেখা যাবে।’

দ্বারের দিকে অগ্রসর হইয়াছি‌, কালো পদার আড়ালে জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। তুলসী এতক্ষণ পদার কাছে দাঁড়াইয়া আমাদের কথা শুনিতেছিল‌, এখন সরীসৃপের মত সরিয়া গেল।

রাত্রে আহারাদির পর পাণ্ডেজির বাসার খাওলা ছাদে তিনটি আরাম-কেদারায় তিনজন অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছিলাম। অন্ধকারে ধূমপান চলিতেছিল। এখানে কার্তিক মাসের এই সময়টি বড় মধুর; দিনে একটু মোলায়েম গরম‌, রাত্রে মোলায়েম ঠাণ্ডা।

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘এবার বলুন কি মনে হল।’

ব্যোমকেশ সিগারেটে দু’ তিনটা টান দিয়া বলিল‌, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন‌, গলদ আছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে যতক্ষণ না চেপে বসা যাচ্ছে ততক্ষণ গলদ ধরা যাবে না।’

‘আপনি তো আজ তার গৌরচন্দ্ৰিক করে এসেছেন। কিন্তু নিতান্তাই কি দরকার–?’

‘দরকার। এতদূর থেকে সুবিধা হবে না। ওদের সঙ্গে ভাল করে মিশতে হবে তবে ওদের পেটের কথা জানা যাবে। আজ লক্ষ্য করলাম‌, কেউ মন খুলে কথা কইছে না‌, সকলেই কিছু-না-কিছু চেপে যাচ্ছে।’

‘হুঁ। তাহলে আপনার বিশ্বাস হয়েছে যে ঈশানবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক সর্পাঘাতে মৃত্যু নয়?’ ‘অতটা বলবার এখনও সময় হয়নি। এইটুকু বলতে পারি‌, আপাতদৃষ্টিতে যা দেখা যাচ্ছে তা সত্যি নয়‌, ভেতরে একটা গুঢ় এবং চমকপ্রদ রহস্য রয়েছে। মোহর কোথা থেকে এল? টৰ্চটা কোথায় গেল? রমাপতি যে-গল্প শোনালে তা কি সত্যি? সবাই দুৰ্গটা চায় কেন? মণিলালকে কর্তা  ছাড়া কেউ দেখতে পারে না কেন?’

আমি বলিলাম‌, ‘মণিলালও রমাপতিকে দেখতে পারে না।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওটা স্বাভাবিক। ওরা দু’জনেই রামকিশোরবাবুর আশ্রিত। রমাপতিও বোধহয় মণিলালকে দেখতে পারে না। বাড়ির কেউ কাউকে দেখতে পারে না। সেটা আমাদের পক্ষে সুবিধে।’ দগ্ধাবশিষ্ট সিগারেট ফেলিয়া দিয়া সে বলিল‌, ‘আচ্ছা পাণ্ডেজি‌, বংশীধর কতদূর লেখাপড়া করেছে জানেন?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘ম্যাট্রিক পাশ করেছে জানি। তারপর বহরমপুরে পড়তে গিয়েছিল‌, কিন্তু মাস কয়েক পরেই পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে।’

‘গোলমাল ঠেকছে। বহরমপুরে ঈশানবাবুর সঙ্গে বংশীধরের জানা-শোনা হয়েছিল—তারপর বংশীধর হঠাৎ লেখাপড়া ছেড়ে দিলে কেন?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘খোঁজ নিতে পারি। বেশি দিনের কথা নয়‌, যদি গোলমাল থাকে কলেজের সেরেস্তায় হদিস পাওয়া যাবে।’

‘খবর নেবেন তো। —আর মুরলীধরের বিদ্যে কতদূর?’

‘ওটা আকাট মুখ্‌খু।’

‘হুঁ, বংশটাই চাষাড়ে হয়ে গেছে। তবে রামকিশোরবাবুর ব্যবহারে একটা সাবেক ভদ্রতা আছে।’

‘কিন্তু বাল্যবন্ধুর মৃত্যুতে খুব বেশি শোক পেয়েছেন বলে মনে হল না; বরং মোহরটি বাগাবার মতলব!’

ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল‌, ‘এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভুরি ভুরি।–কাল সকালে ঈশানবাবুর জিনিসপত্রগুলো পরীক্ষা করতে হবে‌, খাতাটা পড়তে হবে। তাতে হয়তো কিছু পাওয়া যেতে পারে।’

‘তারপর?’

‘তারপর দুর্গে গিয়ে গ্যাট হয়ে বসব। আপনি ব্যবস্থা করুন।’

‘ভাল। কিন্তু একটা কথা ওদের দেওয়া খাবার খাওয়া চলবে না। কি জানি কার মনে কি আছে—’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আপনার ইকমিক কুকার আছে?’

‘আছে।’

‘ব্যস‌, তাহলেই চলবে।’

কিছুক্ষণ নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশ আর একটা সিগারেট ধরাইয়া বলিল‌, ‘অজিত‌, রামকিশোরবাবুকে দেখে কিছু মনে হল?’

0 Shares