দুর্গরহস্য

‘কি মনে হবে?’

‘আজ তাঁকে দেখেই মনে হল‌, আগে কোথায় দেখেছি। তোমার মনে হল না?’

‘কৈ না!’

‘আমার কিন্তু এক নজর দেখেই মনে হল চেনা লোক। কিন্তু কবে কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না।’

পাণ্ডে একটা হাই চাপিয়া বলিলেন‌, ‘রামকিশোরবাবুকে আপনার দেখার সম্ভাবনা কম; গত পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি লোকালয়ে পা বাড়িয়েছেন। কিনা সন্দেহ। আপনি হয়তো ওই ধরনের চেহারা অন্য কোথাও দেখে থাকবেন।’

একটু চুপ করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাই হবে বোধ হয়।’

পরদিন প্রাতরাশের সময় পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘দুর্গে গিয়ে থাকার সঙ্কল্প ঠিক আছে?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ‌, আপনি ব্যবস্থা করুন। বড় জোর দু-তিন দিন থাকিব‌, বেশি নয়।’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আমার কিন্তু মন চাইছে না‌, কি জানি যদি সত্যিই সাপ থাকে।’

ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল‌, ‘থাকলেও আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমরা সাপের রোজা।’

‘বেশ‌, আমি তাহলে রামকিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করে সব ঠিকঠাক করে আসি। —আচ্ছা‌, দুর্গের বদলে যদি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে থাকেন তাতে ক্ষত কি?’

‘অত ঘেঁষাঘেঁষি সুবিধা হবে না‌, পরিপ্রেক্ষিত পাব না। দুৰ্গই ভাল।’

‘ভাল। আমি অফিসে বলে যাচ্ছি‌, আমার মুনশী আতাউল্লাকে খবর দিলে সে ঈশানবাবুর জিনিসপত্র আপনাদের দেখাবে। গুদাম ঘরের চাবি তার কাছে।’

পাণ্ডেজি মোটর-বাইকে চড়িয়া প্ৰস্থান করিলেন। ঘড়িতে মাত্ৰ নটা বাজিয়াছে‌, পাণ্ডেজির অফিস তাঁহার বাড়িতেই; সুতরাং ঈশানবাবুর মালপত্র পরীক্ষার তাড়া নাই। আমরা সিগারেট ধরাইয়া সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইয়া গড়িমসি করিতেছি‌, এমন সময় একটি ছোট মোটর আসিয়া দ্বারে দাঁড়াইল। ব্যোমকেশ জানোলা দিয়া দেখিয়া বলিল‌, ‘ডাক্তার ঘটক। ভালই হল।’

ডাক্তার ঘটকের একটু অনুতপ্ত ভাব। আমরা যে তাহার গুপ্তকথা ফাঁস করিয়া দিই নাই এবং ভবিষ্যতে দিব না। তাহা সে বুঝিয়াছে। বলিল‌, ‘কাল আপনাদের সঙ্গে ভাল করে কথা বলবার সুযোগ পেলাম না‌, তাই–’

ব্যোমকেশ পরম সমাদরের সহিত তাহাকে বসাইয়া বলিল‌, ‘আপনি না এলে আমরাই যেতম। কেমন আছেন বলুন। পুরোনো বন্ধুরা সব কেমন? মহীধরবাবু?’

ডাক্তার বলিল‌, ‘সবাই ভাল আছেন।’

ব্যোমকেশ চক্ষু মিটমিট করিয়া মৃদুহাস্যে বলিল‌, ‘আর রজনী দেবী? ডাক্তারের কান দু’টি রক্তাভ হইল‌, তারপর সে হাসিয়া ফেলিল। বলিল‌, ‘ভাল আছে রজনী। আপনারা এসেছেন শুনে জানতে চাইল মিসেস বক্সী এসেছেন কি না।’

‘সত্যবতী এবার আসেনি। সে–’ ব্যোমকেশ আমার পানে তাকাইল।

আমি সত্যবতীর অবস্থা জানাইয়া বলিলাম, সত্যবতী আমাদের কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমরাও প্রতিজ্ঞা করেছি‌, একটা সুখবর না পাওয়া পর্যন্ত ওমুখে হব না।’

ডাক্তার হাসিয়া ব্যোমকেশকে অভিনন্দন জানাইল‌, কিন্তু তাহার মুখে হাসি ভাল ফুটিল না। ক্ষুধিত ব্যক্তি অন্যকে আহার করিতে দেখিলে হাসিতে পারে‌, কিন্তু সে হাসি আনন্দের নয়।

ব্যোমকেশ তাহার মুখের ভাব দেখিয়া মনের ভাব বুঝিল‌, পিঠ চাপড়াইয়া বলিল‌, ‘বন্ধু‌, মনে ক্ষোভ রাখবেন না। আপনি যা পেয়েছেন তা কম লোকের ভাগেই জোটে। একসঙ্গে দাম্পত্য-জীবনের মাধুর্য আর পরকীয়াপ্রীতির তীক্ষ্ণ স্বাদ উপভোগ করে নিচ্ছেন।’

আমি যোগ করিয়া দিলাম‌, ‘ভেবে দেখুন‌, শেলী বলেছেন‌, হে পবন‌, শীত যদি আসে বসন্ত রহে কি কভু দূরে। ফুলের মরসুম শেষ হোক‌, ফল আপনি আসবে।’

এবার ডাক্তারের মুখে সত্যকার হাসি ফুটিল। আরও কিছুক্ষণ হাসি-তামাসার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘ডাক্তার ঘটক, কাল রামকিশোরবাবুর বাড়িতে বিষয়-ঘটিত আলোচনা খানিকটা শুনেছিলাম‌, বাকিটা শোনবার কৌতুহল আছে। যদি বাধা না থাকে আপনি বলুন।’

ডাক্তার বলিল‌, ‘বাধা কি? রামকিশোরবাবু তো লুকিয়ে কিছু করছেন না। মাসখানেক আগে ওঁর স্বাস্থ্যু হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে; হৃদযন্ত্রের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। এখন অনেকটা সামলেছেন; কিন্তু ওঁর ভয় হয়েছে হঠাৎ যদি মারা যান তাহলে বড় ছেলেরা মামলা-মোকদ্দমায় সম্পত্তি নষ্ট করবে। হয়তো নাবালক ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করবার চেষ্টা করবে। তাই বেঁচে থাকতে থাকতেই উনি সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতে চান। সম্পত্তি সমান চার ভাগ হবে; দুভাগ বড় দুই ছেলে পাবে‌, বাকি দুভাগ রামকিশোরের অধিকারে থাকবে। তারপর ওঁর মৃত্যু হলে গদাই আর তুলসী ওয়ারিসান সূত্রে ওঁর সম্পত্তি পাবে‌, বড় দুই ছেলে আর কিছু পাবে না।’

ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল‌, ‘বুঝেছি। দুর্গ নিয়ে কি ঝগড়া হচ্ছিল?’

‘দুৰ্গটা রামকিশোরবাবু নিজের দখলে রেখেছেন। অথচ দুই ছেলেরই লোভ দুর্গের ওপর।’

‘মণিলালকে দুর্গ দেবার কথা উঠল কেন?’

‘ব্যাপার হচ্ছে এই—ব্রামকিশোরবাবু স্থির করেছেন তুলসীর সঙ্গে মণিলালের বিয়ে দেবেন। মণিলাল ওঁর বড় মেয়েকে বিয়ে করেছিল‌, সে-মেয়ে মারা গেছে‌, জানেন বোধ হয়। কাল কথায় কথায় রামকিশোরবাবু বলেছিলেন‌, তাঁর মৃত্যুর পর বসতবাড়িটা পাবে গদাই‌, আর মণিলাল পাবে দুর্গ। মণিলাল মানেই তুলসী‌, মণিলালকে আলাদা কিছু দেওয়া হচ্ছে না। তাইতেই বংশী আর মুরলী ঝগড়া শুরু করে দিলে।’

‘হুঁ। কিন্তু তুলসীর বিয়ের তো এখনও দেরি আছে। ওর কতাই বা বয়স হবে।’

‘আধুনিক মতে বিয়ের বয়স না হলেও নেহাৎ ছোট নয়‌, বছর তোর-চোদ হবে। রামকিশোরবাবু বোধহয় শীগগিরই ওদের বিয়ে দেবেন। যদি হঠাৎ মারা যান‌, নাবালক ছেলেমেয়েদের একজন নির্ভরযোগ্য অভিভাবক চাই তো! বড় দুই ছেলের ওপর ওঁর কিছুমাত্র আস্থা নেই।’

0 Shares