দুর্গরহস্য

‘যেটুকু দেখেছি তাতে আস্থা থাকার কথা নয়। মণিলাল মানুষটি কেমন?’

‘মাথা-ঠাণ্ডা লোক। রামকিশোরবাবু তাই ওর ওপরেই ভরসা রাখেন বেশি। তবে যেভাবে শ্বশুরবাড়ি কামড়ে পড়ে আছে তাতে মনে হয় চক্ষুলজ্জা কম।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ শূন্যে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিল‌, ‘ডাক্তার ঘটক‌, আপনি রুগী সম্বন্ধে একটু সাবধান থাকবেন।’

ডাক্তার চকিত হইয়া বলিল‌, ‘রুগী! কোন রুগী?’

‘রামকিশোরবাবু। তাঁর হৃদযন্ত্র যদি দলিল রেজিস্ট্রি হবার আগেই হঠাৎ থেমে যায় তাহলে কারুর সুবিধা হতে পারে।’

ডাক্তার চোখ বড় বড় করিয়া চাহিয়া রহিল।

বেলা দশটা নাগাদ ডাক্তার বিদায় লইলে আমরা মুনশী আতাউল্লাকে খবর পাঠাইলাম।

আতাউল্লা লোকটি অতিশয় কেতাদুরন্ত প্রৌঢ় মুসলমান‌, বোধহয় খানদানী ব্যক্তি। কৃশ দেহে ছিটের আচকান‌, দাড়িতে মেহেদির রঙ‌, চোখে সুমা‌, মুখে পান; তাহার চোস্ত জবানের সঙ্গে মুখ হইতে ফুলিঙ্গের ন্যায় পানের কুচি ছিটুকাইয়া পড়িত। লোকটি সজ্জন।

আমাদের অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া মুনশী আতাউল্লা দুইজন আরদালির সাহায্যে ঈশানবাবুর বিছানা ও তোরঙ্গ আনিয়া আমাদের খিদমতে পেশ করিলেন। বিছানাটা নামমাত্র। রঙ-ওঠা সতরঞ্চিতে জড়ানো জীৰ্ণ বাঁদিপোতার তোষক ও তেলচিটে বালিশ। তবু ব্যোমকেশ উহা ভাল করিয়া পরীক্ষা করিল। তোষকটি ঝাড়িয়া এবং বালিশটি টিপিয়া টুপিয়া দেখিল‌, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে গুপ্ত ধাতব পদার্থের অস্তিত্ব ধরা পড়িল না।

বিছানা স্থানান্তরিত করিবার হুকুম দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘মুন্‌শীজি, একটা মোহর ছিল সেটা দেখতে পাওয়া যাবে কি?’

‘বেশক্‌‌, জনাব। আপনার যদি মরজি হয় তাই আমি মোহর সঙ্গে এনেছি।’ আতাউল্লা আচুকানের পকেট হইতে একটি কাঠের কোটা বাহির করিলেন। কোটার গায়ে নানাপ্রকার সাঙ্কেতিক অক্ষর ও চিহ্ন অঙ্কিত রহিয়াছে। ভিতরে তুলার মোড়কের মধ্যে মোহর।

পাক সোনার মোহর; আকারে আয়তনে বর্তমান কালের চাঁদির টাকার মত। ব্যোমকেশ। উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া বলিল‌, ‘এতে উর্দুতে কি লেখা রয়েছে পড়তে পারেন?’

আতাউল্লা ঈষৎ আহত-কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘উর্দু নয় জনাব‌, ফারসী। আসরফিতে উর্দু লেখার রেওয়াজ ছিল না। যদি ফরমাস করেন পড়ে দিতে পারি‌, ফারসী আমার খাস জবান।’

ব্যোমকেশ অপ্ৰস্তুত হইয়া বলিল‌, ‘তাই নাকি! তাহলে পড়ে বলুন দেখি কবেকার মোহর।’ আতাউল্লা চশমা আটিয়া মোহরের লেখা পড়িলেন‌, বলিলেন‌, ‘তারিখ নেই। লেখা আছে। এই মোহর নবাব আলিবর্দি খাঁর আমলে ছাপা হয়েছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে জানকীরামের কালের মোহর‌, পরের নয়।–আচ্ছ মুনশীজি‌, আৰু বহুত বহুত ধন্যবাদ‌, আপনি অফিসে যান‌, যদি আবার দরকার হয় আপনাকে খবর পাঠাব।’

‘মেহেরবানি’ বলিয়া আতাউল্লা প্ৰস্থান করিলেন।

ব্যোমকেশ তখন অধ্যাপক মহাশয়ের তোরঙ্গটি টানিয়া লইয়া বসিল। চট-ওঠা টিনের তোরঙ্গটির মধ্যে কিন্তু এমন কিছুই পাওয়া গেল না যাহা তাঁহার মৃত্যুর কারণ-নির্দেশে সাহায্য করিতে পারে। বস্ত্ৰাদি নিত্যব্যবহার্য জিনিসগুলি দেখিলে মনে হয় অধ্যাপক মহাশয় অল্পবিত্ত ছিলেন কিম্বা অতিশয় মিতব্যয়ী ছিলেন। দুইখানি পুরাতন মলাট-ছেড়া বই; একটি শ্যামশাস্ত্রী-সম্পাদিত কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰ‌, অন্যটি শয়র-ই-মুতাক্ষরিনের ইংরেজি অনুবাদ। ইতিহাসের গণ্ডীর মধ্যে অধ্যাপক মহাশয়ের জ্ঞানের পরিধি কতখানি বিস্তৃত ছিল‌, এই বই দু’খানি হইতে তাহার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

বই দু’খানির সঙ্গে একখানি চামড়া-বাঁধানো প্রাচীন খাতা। খাতাখানি বোধ হয় ত্রিশ বছরের পুরাতন; মলাটা ঢলঢলে হইয়া গিয়াছে‌, ব্বিৰ্ণ পাতাগুলিও খসিয়া আসিতেছে। এই খাতায় অত্যন্ত অগোছালভাবে‌, কোথাও পেন্সিল দিয়া দু’চার পাতা‌, কোথাও কালি দিয়া দু’চার ছত্র লেখা রহিয়াছে। হস্তাক্ষর সুছাঁদ নয়‌, কিন্তু একই হাতের লেখা। যাহাদের লেখাপড়া লইয়া কাজ করিতে হয় তাহারা এইরূপ একখানি সর্বাংবহা খাতা হাতের কাছে রাখে; যখন যাহা ইচ্ছা ইহাতে টুকিয়া রাখা যায়।

খাতাখানি সযত্নে লইয়া আমরা টেবিলে বসিলাম! ব্যোমকেশ একটি একটি করিয়া পাতা উল্টাইতে লাগিল।

প্রথম দুই-তিনটি পাতা খালি। তারপর একটি পাতায় লেখা আছে

ইতিহাসের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা

যদি মানুষের ভাষায় কথা বলিতে

পারিতেন তবে তিনি মহরমের

বাজনার ছন্দে বলিতেন–

ধনানর্জয়ধ্বম্‌! ধনানর্জয়ধ্বম্‌!

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘মহরমের বাজনার মত শোনাচ্ছে বটে‌, কিন্তু মানে কি?

বলিলাম‌, মনে হচ্ছে‌, ধন উপার্জন করহ‌, ধন উপার্জন করহ। তোমার ঈশানবাবু দেখছি সিনিক ছিলেন।’

ব্যোমকেশ লেখাটাকে আরও কিছুক্ষণ দেখিয়া পাতা উল্টাইল। পরপৃষ্ঠায় কেবল কয়েকটি তারিখ নোট করা রহিয়াছে। ঐতিহাসিক তারিখ; কবে হিজরি অব্দ আরম্ভ হইয়াছিল, শশাঙ্ক দেবের মৃত্যুর তারিখ কি‌, এইসব। বোধ হয়। ছাত্রদের ইতিহাস পড়াইবার জন্য নোট করিয়াছিলেন। এমনি আরও কয়েক পৃষ্ঠায় তারিখ লেখা আছে‌, সেগুলির উল্লেখ করিবার প্ৰয়োজন নাই।

ইহার পর আরও কয়েক পাতা শূন্য। তারপর সহসা এক দীর্ঘ রচনা শুরু হইয়াছে। তাহার আরম্ভটা এইরূপ–

‘রামবিনোদের কাছে তাহার বংশের ইতিহাস শুনিলাম। সিপাহী-যুদ্ধের সময় লুঠেরাগণ বোধ হয় সঞ্চিত ধনরত্ন লইয়া যাইতে পারে নাই; অন্তত রামবিনোদের তাঁহাই বিশ্বাস। সে দুর্গ দেখিয়া আসিয়াছে। তাহার উচ্চাশা‌, যদি কোনও দিন ধনী হয় তখন ঐ দুর্গ কিনিয়া তথায় গিয়া বাস করিবে।’

0 Shares