অতঃপর জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া রাজারাম জয়রাম পর্যন্ত রমাপতির মুখে। যেমন শুনিয়াছিলাম ঠিক তেমনি লেখা আছে, একচুল এদিক ওদিক নাই। পাঠ শেষ হইলে আমি বলিলাম, যাক, একটা বিষয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, রমাপতি মিথ্যে গল্প বলেনি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘গল্পটা রমাপতি ঠিকই বলেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু গল্পটা ঈশানবাবুর মৃত্যুর রাত্রে শুনেছিল তার প্রমাণ কি? দুদিন আগেও শুনে থাকতে পারে।’
‘তা—বটে। তাহলে–?’
‘তাহলে কিছু না। আমি বলতে চাই যে, ও সম্ভাবনাটাকেও বাদ দেওয়া যায় না। অৰ্থাৎ রমাপতি সে-রত্রে এই গল্পই শুনেছিল এবং পরদিন ভোরবেলা গল্পের বাকিটা শোনবার জন্যে ঈশানবাবুর কাছে গিয়েছিল তার কোনও প্রমাণ নেই।’
আবার কিছুক্ষণ পাতা উল্টাইবার পর এমন একটি পৃষ্ঠায় আসিয়া পৌঁছিলাম, যেখানে তীব্র কাতরোক্তির মত কয়েকটি শব্দ লেখা রহিয়াছে–
–রামবিনোদ বাঁচিয়া নাই। আমার
একমাত্র আকৃত্রিম বন্ধু চলিয়া গিয়াছে।
সে কি ভয়ঙ্কর মৃত্যু! দুঃস্বপ্নের মত
সে-দৃশ্য আমার চোখে লাগিয়া আছে।
ব্যোমকেশ লেখাটার উপর কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থাপিত রাখিয়া বলিল, ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যু। স্বাভাবিক মৃত্যু বলে মনে হয় না। খোঁজ করা দরকার।’ আমার মুখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন দেখিয়া মৃদুকণ্ঠে আবৃত্তি করিল, ‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ ভাই, পাইলে পাইতে পার লুকানো রতন।’
খাতার সামনের দিকের লেখা এইখানেই শেষ। মনে হয় রামবিনোদের মৃত্যুর পর খাতাটি দীর্ঘকাল অব্যবহৃত পড়িয়া ছিল, হয়তো হারাইয়া গিয়াছিল। তারপর আবার যখন লেখা আরম্ভ হইয়াছে, তখন খাতার উল্টা পিঠ হইতে।
প্রথম লেখাটি কালি-কলমের লেখা; পীতবর্ণ কাগজে কালি চুপসিয়া গিয়াছে। পাতার মাথার দিকে লেখা হইয়াছে–
রামকিশোরের বড় ছেলে বংশীধর কলেজে পড়িতে আসিয়াছে।
অনেকদিন পরে উহাদের সঙ্গে আবার সংযোগ ঘটিল। সেই
রামবিনোদের মৃত্যুর পর আর খোঁজ লই নাই।
পাতার নীচের দিকে লেখা আছে-বংশীধর এক মারাত্মক
কেলেঙ্কারি করিয়াছে। তাহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছি।
হাজার হোক রামবিনোদের ভ্রাতুষ্পুত্ৰ।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বংশীধরের কেলেঙ্কারির হদিস বোধ হয় দু’চার দিনের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু এ কি?’
দেখা গেল বাকি পাতাগুলিতে যে লেখা আছে তাহার সবগুলিই লাল-নীল পেন্সিলে লেখা। ব্যোমকেশ পাতাগুলি কয়েকবার ওলট-পালট করিয়া বলিল, ‘অজিত, তেরঙ্গের তলায় দেখ তো লাল-নীল পেন্সিল আছে কি না।’
বেশি খুঁজতে হইল না, একটি দুমুখো লাল-নীল পেন্সিল পাওয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক, বোঝা গেল। এর পর যা কিছু লেখা আছে ঈশানবাবু দুর্গে আসার পর লিখেছেন। এগুলি তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়।’
প্ৰথম লেখাটি এইরূপ
দুৰ্গে গুপ্তকক্ষ দেখিতে পাইলাম না।
ভারি আশ্চর্য! দুর্গের সোনাদানা কোথায় রক্ষিত হইত?
প্ৰকাশ্য কক্ষে রক্ষিত হইত বিশ্বাস হয় না। নিশ্চয়
কোথাও গুপ্তকক্ষ আছে। কিন্তু কোথায়? সিপাহীরা
গুপ্তকক্ষের সন্ধান পাইয়া থাকিলে গুপ্তকক্ষ আর গুপ্ত
থাকিত না, তাহার দ্বারা ভাঙ্গিয়া রাখিয়া যাইত, তখন
উহা সকলেরই দৃষ্টিগোচর হইত। তবেই গুপ্তকক্ষের
সন্ধান সিপাহীরা পায় নাই।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘অধ্যাপক মহাশয়ের যুক্তিটা খুব বিচারসহ নয়। সিপাহীরা চলে যাবার পর রাজারামের পরিবারবর্গ ফিরে এসেছিল। তারা হয়তো ভাঙা তোষাখানা মেরামত করিয়েছিল, তাই এখন ধরা যাচ্ছে না।’
পাতা উল্টাইয়া ব্যোমকেশ পড়িল—
কেহ আমাকে ভয় দেখাইয়া দুৰ্গ হইতে তাড়াইবার চেষ্টা
করিতেছে। বংশীধর? আমি কিন্তু সহজে দুর্গ ছাড়িব
না! ধনানর্জয়ধ্বম্! ধনানর্জয়ধ্বম্!
জিজ্ঞাসা করিলম, ‘আবার মহরমের বাজনা কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহরের গন্ধ পেয়ে বোধ হয় তাঁর স্নায়ুমণ্ডলী উত্তেজিত হয়েছিল।’
অতঃপর কয়েক পৃষ্ঠা পরে খাতার শেষ লেখা। আমরা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। বাংলা ভাষায় লেখা নয়, উর্দু কিংবা ফারসীতে লেখা তিনটি পংক্তি। তাহার নীচে বাংলা অক্ষরে কেবল দুইটি শব্দ-মোহনলাল কে?
ব্যোমকেশ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘সত্যিই তো, মোহনলাল কে? এ প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া আমাদের কর্ম নয়। ডাকো মুনশী আতাউল্লাকে।’
আতাউল্লা আসিয়া লিপির পাঠোদ্ধার করিলেন। বলিলেন, ‘জনাব, মৃত ব্যক্তি ভাল ফারসী জানতেন মনে হচ্ছে। তবে একটু সেকেলে ধরনের। তিনি লিখেছেন, যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিন্মায় গচ্ছিত রহিল।’
‘মোহনলালের জিম্মায়–!’
‘জী জনাব, তাই লেখা আছে।’
‘হুঁ। আচ্ছা, মুনশীজি, আপনি এবার জিনিসপত্র সব নিয়ে যান। কেবল এই খাতাটা আমার কাছে রইল।’
দু’জনে সিগারেট ধরাইয়া আরাম-কেদারার কোলে অঙ্গ ছড়াইয়া দিলাম। নীরবে একটা সিগারেট শেষ করিয়া তাহারই চিতাগ্নি হইতে দ্বিতীয় সিগারেট ধরাইয়া বলিলাম, ‘খাতা পড়ে কি মনে হচ্ছে?’
ধনানর্জয়ধ্বম্। ধনানর্জয়ধ্বম্।
‘ঠাট্টা নয়, কি বুঝলে বল না।’
‘পরিষ্কারভাবে কিছুই বুঝিনি এখনও। তবে ঈশানবাবুকে যদি সত্যিই কেউ হত্যা করে থাকে তাহলে হত্যার মোটিভ দেখতে পাচ্ছি।’
‘কি মোটিভ?’
‘সেই চিরন্তন মোটিভ–টাকা।’
‘আচ্ছা, ফারসী ভাষায় ঐ কথাগুলো লিখে রাখার তাৎপৰ্য কি?’
‘ওটা উনি নিজে লেখেননি। অর্থাৎ হস্তাক্ষর ওঁর, কিন্তু রচনা ওঁর নয়, রাজারামের। উনি লেখাটি দুর্গে কোথাও পেয়েছিলেন, তারপর খাতায় টুকে রেখেছিলেন।’