দুর্গরহস্য

‘তারপর?’

‘তারপর মারা গেলেন।’

পাণ্ডেজি ফিরিলেন বেলা বারোটার পর। হেলমেট খুলিয়া ফেলিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন‌, ‘কাজ হল বটে কিন্তু বুড়ো গোড়ায় গোলমাল করেছিল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গোলমাল কিসের?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘বেলা হয়ে গেছে‌, খেতে বসে সব বলব। আপনি কিছু পেলেন?’

‘খেতে বসে বলব।’

আহারে বসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনি আগে বলুন। কাল তো রামকিশোরবাবু নিমরাজী ছিলেন‌, আজ হঠাৎ বেঁকে বসলেন কেন?’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘কাল আমরা চলে আসবার পর কেউ ওঁকে বলেছে যে আপনি একজন বিখ্যাত ডিটেকটিভ। তাতেই উনি ঘাবড়ে গেছেন।’

‘এতে ঘাবড়াবার কি আছে? ওঁর মনে যদি পাপ না থাকে–’

‘সেই কথাই শেষ পর্যন্ত আমাকে বলতে হল। বললাম‌, ‘হলাই বা ব্যোমকেশবাবু ডিটেকটিভ‌, আপনার ভয়টা কিসের? আপনি কি কিছু লুকোবার চেষ্টা করেছেন?’ তখন বুড়ো তাড়াতাড়ি রাজী হয়ে গেল।’

পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘আমার তাই সন্দেহ হল। কিন্তু ঈশানবাবুর মৃত্যুঘটিত কোনো কথা নয়। অন্য কিছু। যা হোক‌, আমি ঠিক করে এসেছি‌, আজই ওরা দুৰ্গটাকে আপনাদের বাসের উপযোগী করে রাখবে। আপনারা ইচ্ছে করলে আজ বিকেলে যেতে পারেন। কিম্বা কাল সকালে যেতে পারেন।’

‘আজ বিকেলেই যাব।’

‘তাই হবে। কিন্তু আমি আর একটা ব্যবস্থা করেছি। আমার খাস আরদালি সীতারাম আপনাদের সঙ্গে থাকবে।’

‘না না‌, কি দরকার?’

‘দরকার আছে। সীতারাম লাল পাগড়ি পরে যাবে না‌, সাধারণ চাকর সেজে যাবে। লোকটা খুব কুঁশিয়ার; তাছাড়া‌, ওর একটা মস্ত বিদ্যে আছে‌, ও সাপের রোজা। ও সঙ্গে থাকলে অনেক সুবিধে হবে। ভেবে দেখুন‌, আপনাদের জল তোলা কাপড় কাচা বাসন মাজার জন্যেও একজন লোক দরকার। ওদের লোক না নেওয়াই ভাল।’

ব্যোমকেশ সম্মত হইল। পাণ্ডে তখন বলিলেন‌, ‘এবার আপনার হাল বিয়ান করুন।’

ব্যোমকেশ সবিস্তারে ঈশানবাবুর খাতার রহস্য উদঘাটিত করিল। শুনিয়া পাণ্ডে বলিলেন‌, ‘হুঁ‌, মোহনলাল লোকটা কে ছিল আমারও জানতে ইচ্ছে হচ্ছে‌, কিন্তু একশো বছর পরে আর তার ঠিকানা বার করা সম্ভব হবে না। এদিকে হালের খবর ঈশানবাবু লিখছেন‌, তাঁকে কেউ ভয় দেখিয়ে দুর্গ থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে। তাঁর সন্দেহ বংশীধরের ওপর। কিন্তু সত্যি কথাটা কি? ভয়ই বা দেখালো কী ভাবে?’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘এ সব প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাবে না। দেখা যাক‌, দুর্গে গিয়ে যদি দুর্গের রহস্য ভেদ করা যায়।’

অপরাহ্নে পুলিস ভ্যানে চড়িয়া শৈল-দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা তিনজন এবং সীতারাম। পাণ্ডেজি আমাদের ঘর-বসতি করিয়া দিয়া ফিরিয়া যাইবেন‌, সীতারাম থাকিবে। সীতারামের বয়স পয়ত্ৰিশ‌, লিকলিকে লম্বা গড়ন‌, তামাটে ফস রঙ‌, শিকারী বিড়ালের মত গোঁফ { তাহার চেহারার মাহাত্ম্য এই যে‌, সে ভাল কাপড়চোপড় পরিলে তাহাকে ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়‌, আবার নেংটি পরিয়া থাকিলে বাসন-মাজা ভূত্য মনে করিতে তিলমাত্র দ্বিধা হয় না। উপস্থিত তাহার পরিধানে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় কাঁধে গামছা। অথাৎ‌, মোটা কাজের চাকর।

আমাদের সঙ্গে লটবহর কম ছিল না‌, বিছানা বাক্স‌, চাল ডাল আনাজ প্রভৃতি রসদ‌, ইকমিক কুকার এবং আরও কত কি। সীতারাম এবং বুলাকিলাল মালপত্র দুর্গে ঢোলাই করিতে আরম্ভ করিল। পাণ্ডে বলিলেন‌, চলুন‌, গৃহস্বামীর সঙ্গে দেখা করে আসবেন।’

গৃহস্বামী বৃড়ির সদর বারান্দায় উপবিষ্ট ছিলেন‌, সঙ্গে জামাই মণিলাল‌, আমাদের সম্ভাষণ জানাইলেন; আমরা খাবার ব্যবস্থা নিজেরাই করিয়াছি বলিয়া অনুযোগ করিলেন; শহুরে মানুষ পাহাড়ে জঙ্গলে মন বসাইতে পারিব না বলিয়া রসিকতা করিলেন। কিন্তু তাঁহার চক্ষু সতর্ক ও সাবধান হইয়া রহিল।

মিষ্টালাপের সময় লক্ষ্য করিলম‌, বাড়ির অন্যান্য অধিবাসীরা আমাদের শুভাগমনে বেশ চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। বংশীধর এবং মুরলীধর চিলের মত চক্রাকারে আমাদের চারিদিকে পরিভ্রমণ করিতেছে‌, কিন্তু কাছে আসিতেছে না। রমাপতি একবার বাড়ির ভিতর হইতে গলা বাড়াইয়া আমাদের দেখিয়া নিঃশব্দে সরিয়া গেল। নায়েব চাঁদমোহন বারান্দার অন্য প্রান্তে থেলো ইঁহঁকোয় তামাক টানিতে টানিতে বক্র দৃষ্টিশলাকায় আমাদের বিদ্ধ করিতেছেন। তুলসী একটা জুই ঝাড়ের আড়াল হইতে কৌতুহলী কাঠবিড়ালীর মত আমাদের নিরীক্ষণ করিয়া ছুটিয়া চলিয়া গেল; কিছুক্ষণ পরে দেখিলাম একটা থামের আড়াল হইতে সে উঁকি মারিতেছে।

ব্যোমকেশ যে একজন খ্যাতনামা গোয়েন্দা এবং কোনও গভীর অভিসন্ধি লইয়া দুর্গে বাস করিতে আসিয়াছে তাহা ইহারা জানিতে পারিয়াছে এবং তদনুযায়ী উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। কেবল গদাধরের জড়বুদ্ধি বোধ হয় এতবড় ধাক্কাতেও সক্রিয় হইয়া ওঠে নাই; তাহাকে দেখিলাম। না।

আমরা গাত্ৰোত্থান করিলে রামকিশোরবাবু বলিলেন‌, ‘শুধু থাকার জন্যেই এসেছেন মনে করবেন। না যেন। আপনারা আমার অতিথি‌, যখন যা দরকার হবে খবর পাঠাবেন।’

‘নিশ্চয়‌, নিশ্চয়।’ আমরা গমনোদ্যত হইলাম। গৃহস্বামী ইশারা করিলেন‌, মণিলাল আমাদের সঙ্গে চলিল; উদ্দেশ্য দুর্গ পর্যন্ত আমাদের আগাইয়া দিয়া আসিবে।

সিঁড়ি দিয়া নামা ওঠার সময় মণিলালের সঙ্গে দুই-চারিটা কথা হইল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি যে ডিটেকটিভ একথা রামকিশোরবাবু জানলেন কি করে?’

মণিলাল বলিল‌, ‘আমি বলেছিলাম। আপনার নাম আমার জানা ছিল; এর লেখা বই পড়েছি। শুনে কত খুব উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর আপনারা দুর্গে এসে থাকতে চান শুনে ঘাবড়ে গেলেন।’

0 Shares