‘কেন?’
‘এই সেদিন একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেল—’
‘তাই আপনাদের ভয় আমাদেরও সাপে খাবে। ভালো কথা, আপনার স্ত্রীও না। সর্পাঘাতে মারা গিয়েছিলেন?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘এ অঞ্চলে দেখছি খুব সাপ আছে।’
‘আছে নিশ্চয়। কিন্তু আমি কখনও চোখে দেখিনি।’
দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আমরা দুর্গের সিঁড়ি ধরিলাম। হঠাৎ মণিলাল জিজ্ঞাসা করিল, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনারা পুলিসের লোক, তাই জানতে কৌতুহল হচ্ছে—ঈশানবাবু ঠিক সাপের কামড়েই মারা গিয়েছিলেন তো?’
ব্যোমকেশ ও পাণ্ডের মধ্যে একটা চকিত দৃষ্টি বিনিময় হইল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘কেন বলুন দেখি? এ বিষয়ে সন্দেহ আছে নাকি?’
মণিলাল ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘না—তবে-কিছুই তো বলা যায় না—’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘সাপ ছাড়া আর কি হতে পারে?’
মণিলাল বলিল, ‘সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। ঈশানবাবুর পায়ে সাপের দাঁতের দাগ আমি নিজের চোখে দেখেছি। ঠিক যেমন আমার স্ত্রীর পায়ে ছিল।’ মণিলাল একটা নিশ্বাস ফেলিল।
দুর্গের তোরণে আসিয়া পৌঁছিলাম। মণিলাল বলিল, ‘এবার আমি ফিরে যাব। কর্তার শরীর ভাল নয়, তাঁকে বেশিক্ষণ একলা রাখতে সাহস হয় না। কাল সকালেই আবার আসব।’
মণিলাল নমস্কার করিয়া নামিয়া গেল। সূর্য অস্ত গিয়াছিল। রামকিশোরবাবুর বাড়ির মাথার উপর শুক্লা দ্বিতীয়ার কৃশাঙ্গী চন্দ্ৰকলা মুচকি হাসিয়া বাড়ির আড়ালে লুকাইয়া পড়িল। আমরাও তোরণ দিয়া দুর্গের অঙ্গনে প্রবেশ করিলম। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ সকালে ডাক্তার ঘটককে তার রুগী সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়েছিলাম; এখন দেখছি তার কোনও দরকার ছিল না। সম্পত্তি হস্তান্তরের দলিল রেজিস্ট্রি না হওয়া পর্যন্ত জামাই মণিলাল যক্ষের মত শ্বশুরকে আগলে থাকবে।’
পাণ্ডে একটু হাসিলেন, ‘হ্যাঁ-ঈশানবাবুর মৃত্যু সম্বন্ধে এদের খটকা লেগেছে দেখছি। কিন্তু এখন কিছু বলা হবে না।’
‘না।’
আমরা প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া বাড়ির দিকে চলিলাম। পাণ্ডেজির হাতে একটি মুষলাকৃতি লম্বা টর্চ ছিল; সেটির বৈদ্যুতিক আলো যেমন দূরপ্রসারী, প্রয়োজন হইলে সেটিকে মারাত্মক প্রহরণস্বরূপেও ব্যবহার করা চলে। পাণ্ডে টর্চ জ্বালিয়া তাহার আলো সম্মুখে নিক্ষেপ করিলেন, বলিলেন, ‘এটা আপনাদের কাছে রেখে যাব, দরকার হতে পারে। চলুন, দেখি আপনাদের থাকার কি ব্যবস্থা হয়েছে।’
দেখা গেল সেই গজল-কন্টকিত ঘরটিতেই থাকার বন্দোবস্ত হইয়াছে। দুইটি লোহার খাট, টেবিল চেয়ার প্রভৃতি আসবাব দেওয়ালের নিরাভরণ দৈন্য অনেকটা চাপা দিয়াছে। সীতারাম ইতিমধ্যে লণ্ঠন জ্বালিয়াছে, বিছানা পাতিয়াছে, ইকমিক্ কুকারে রান্না চড়াইয়াছে এবং স্টেভ জ্বলিয়া চায়ের জল গরম করিতেছে। তাহার কর্মতৎপরতা দেখিয়া চমৎকৃত হইলাম।
অচিরাৎ ধূমায়মান চা আসিয়া উপস্থিত হইল। চায়ে চুমুক দিয়া পাণ্ডে বলিলেন, ‘সীতারাম, কেমন দেখলে?’
সীতারাম বলিল, ‘কিল্লা ঘুরে ফিরে দেখে নিয়েছি। হুজুর। এখানে সাপ নেই।’
নিঃসংশয় উক্তি। পাণ্ডে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন, ‘যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।’
‘আর কিছু?’
‘আর, সিঁড়ি ছাড়া কিল্লায় ঢোকবার অন্য রাস্তা নেই। দেয়ালের বাইরে খাড়া পাহাড়।’
ব্যোমকেশ পাণ্ডের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘এর মানে বুঝতে পারছেন?’
‘কি?’
‘যদি কোনও আততায়ী দুৰ্গে ঢুকতে চায় তাকে সিঁড়ি দিয়ে আসতে হবে। অথাৎ, দেউড়ির পাশ দিয়ে আসতে হবে। বুলাকিলাল তাকে দেখে ফেলতে পারে।’
‘হুঁ, ঠিক বলেছেন। বুলাকিলালকে জেরা করতে হবে। কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেছে, আজ আর নয়।–সীতারাম, তোমাকে বেশি বলবার দরকার নেই। এদের দেখাশুনা করবে, আর চোখ কান খুলে রাখবে।’
‘জী হুজুর।’
পাণ্ডেজি উঠিলেন।
‘কাল কোনও সময়ে আসব। আপনারা সাবধানে থাকবেন।’
পাণ্ডেজিকে দুৰ্গতোরণ পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিলাম। ব্যোমকেশ টর্চ জ্বলিয়া সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল, পাণ্ডেজি নামিয়া গেলেন। কিছুকাল পরে নীচে হইতে শব্দ পাইলাম পুলিস ভ্যান চলিয়া গেল। ওদিকে রামকিশোরবাবুর বাড়িতে তখন মিটমিটি আলো জ্বলিয়াছে।
আমরা আবার প্রাঙ্গণে আসিয়া দাঁড়াইলাম। আকাশে তারা ফুটিয়াছে, জঙ্গলের দিক হইতে মিষ্ট বাতাস দিতেছে। সীতারাম যেন আমাদের মনের অকথিত অভিলাষ জানিতে পারিয়া দু’টি চেয়ার আনিয়া অঙ্গনে রাখিয়াছে। আমরা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া উপবেশন করিলম।
এই নক্ষত্রবিদ্ধ অন্ধকারে বসিয়া আমার মন নানা বিচিত্র কল্পনায় পূর্ণ হইয়া উঠিল। আমরা যেন রূপকথার রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছি। সেই যে রাজপুত্র কোঁটালপুত্র কি জানি কিসের সন্ধানে বাহির হইয়া ঘুমস্ত রাজকুমারীর মায়াপুরীতে উপনীত হইয়াছিল, আমাদের অবস্থা যেন সেইরূপ। অবশ্য ঘুমন্ত রাজকুমারী নাই, কিন্তু সাপের মাথায় মণি আছে কিনা কে বলিতে পারে? কোন অদৃশ্য রাক্ষস-রাক্ষসীরা তাহাকে পাহারা দিতেছে তাহাই বা কে জানে? শুক্তির অভ্যন্তরে মুক্তার ন্যায় কোন অপরূপ রহস্য এই প্রাচীন দুর্গের অস্থিপঞ্জীরতলে লুক্কায়িত আছে?
ব্যোমকেশ ফস করিয়া দেশলাই জ্বলিয়া আমার রোমান্টিক স্বপ্নজাল ভাঙিয়া দিল। সিগারেট ধরাইয়া বলিল, ‘ঈশানবাবু ঠিক ধরেছিলেন, দুর্গে নিশ্চয় কোথাও গুপ্ত তোষাখানা আছে।’
বলিলাম, কিন্তু কোথায়? এতবড় দুর্গের মাটি খুঁড়ে তার সন্ধান বার করা কি সহজ? ‘সহজ নয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস ঈশানবাবু সন্ধান পেয়েছিলেন; তাঁর মুঠির মধ্যে মোহরের আর কোনও মানে হয় না।’