কথাটা মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করিয়া শেষে বলিলাম, ‘তা যদি হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে আরও অনেক মোহর আছে।’
‘সম্ভব। এবং তার চেয়েও বড় কথা, ঈশানবাবু যখন খুঁজে বার করতে পেরেছেন তখন অীমরাও পারব।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া অন্ধকারে পায়চারি করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পায়চারি করিবার পর সে হঠাৎ ‘উ’ বলিয়া পড়িয়া যাইতে যাইতে কোনক্রমে সামলাইয়া লইল। আমি লাফাইয়া উঠিলাম–’কি হল!’
‘কিছু নয়, সামান্য হোচট খেয়েছি।’ টৰ্চটা তাহার হাতেই ছিল, সে তাহা জ্বালিয়া মাটিতে আলো ফেলিল।
দিনের আলোতে যাহা চোখে পড়ে নাই, এখন তাহা সহজে চোখে পড়িল। একটা চৌকশ পাথর সম্প্রতি কেহ খুঁড়িয়া তুলিয়াছিল, আবার অপটু হস্তে যথাস্থনে বসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। পাথরটা সমানভাবে বসে নাই, একদিকের কোনা একটু উচু হইয়া আছে। ব্যোমকেশ অন্ধকারে ওই উঁচু কানায় পা লাগিয়া হোঁচট খাইয়াছিল।
আলগা পাথরটা দেখিয়া উত্তেজিত হইয়া উঠিলাম্,–’ব্যোমকেশ! পাথরের তলায় তোষাখানার গর্ত নেই তো?’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, ‘উঁহু, পাথরটা বড় জোর চৌদ্দ ইঞ্চি চৌকশ। ওর তলায় যদি গর্ত থাকেও, তা দিয়ে মানুষ ঢুকতে পারবে না।’
‘তবু–’
‘না হে, যা ভাবিছ তা নয়। খোলা উঠোনে তোষাখানার গুপ্তদ্বার হতে পারে না। যা হোক, কাল সকালে পাথর তুলিয়ে দেখতে হবে।’
ব্যোমকেশ টর্চ ঘুরাইয়া চারিদিকে আলো ফেলিল, কিন্তু অন্য কোথাও পাথরের পার্টি নড়াচাড়া হইয়াছে বলিয়া মনে হইল না। অদূরে কামানটা পড়িয়া আছে, তাহার নীচে অনেক ধূলামটি জমিয়া কামানকে মেঝের সঙ্গে জাম করিয়া দিয়াছে; সেখানেও আলগা মাটি বা পাথর চোখে পড়িল না।’
এই সময় সীতারাম আসিয়া জানাইল, আহার প্রস্তুত। হাতের ঘড়িতে দেখিলাম পৌঁনে দশটা। কখন যে নিঃসাড়ে সময় কাটিয়া গিয়াছে জানিতে পারি নাই।
ঘরে গিয়া আহারে বসিলাম। ইকমিক্ কুকারে রাঁধা খিচুড়ি এবং মাংস যে এমন অমৃততুল্য হইতে পারে তাহা জানা ছিল না। তার উপর সীতারাম অমলেট ভাজিয়াছে। গুরুভোজন হইয়া গেল।
আমাদের ভোজন শেষ হইলে সীতারাম বারান্দায় নিজের আহার সারিয়া লইল। দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, ‘হুজুর, যদি হুকুম হয়, একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ তো। তুমি শোবে কোথায়?’
সীতারাম বলিল, ‘সেজন্যে ভাববেন না হুজুর। আমি দোরের বাইরে বিছানা পেতে শুয়ে থাকব।’
সীতারাম চলিয়া গেল। আমরা আলো কমাইয়া দিয়া বিছানায় লম্বা হইলাম। দ্বার খোলাই রহিল; কারণ ঘরে জানালা নাই, দ্বার বন্ধ করিলে দম বন্ধ হইবার সম্ভাবনা।
শুইয়া শুইয়া বোধহয় তন্দ্ৰা আসিয়া গিয়াছিল, ব্যোমকেশের গলার আওয়াজে সচেতন হইয়া উঠিলাম, ‘দ্যাখো, ঐ গজালগুলো আমার ভাল ঠেকছে না।’
‘গজাল! কোন গজাল?’
‘দেয়ালে এত গজাল কেন? পাণ্ডেজি একটা কৈফিয়ত দিলেন বটে, কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে।’
এত রাত্রে গজালকে সন্দেহ করার কোনও মানে হয় না। ঘড়িতে দেখিলাম। এগারোটা বাজিয়া গিয়াছে। সীতারাম এখনও এদিক ওদিক দেখিয়া ফিরিয়া আসে নাই।
‘আজ ঘুমাও, কাল গজালের কথা ভেব।’ বলিয়া আমি পাশ ফিরিয়া শুইলাম।
৯
গভীর ঘুমাইয়া পড়িয়ছিলাম। হঠাৎ মাথার শিয়রে বোমা ফাটার মত শব্দে ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলাম। মুহুর্তের জন্য কোথায় আছি ঠাহর করিতে পারিলাম না।
স্থানকালের জ্ঞান ফিরিয়া আসিলে দেখিলাম ব্যোমকেশ দ্বারের বাহিরে টর্চের আলো ফেলিয়াছে, সেখানে কতকগুলো ভাঙা হাঁড়ি কলসীর মত খোলামকুচি পড়িয়া আছে। তারপর ব্যোমকেশ জ্বলন্ত টর্চ হাতে লইয়া তীরবেগে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। ‘অজিত, এসো–’
আমিও আলুথালুভাবে উঠিয়া তাহার অনুসরণ করিলম; সে কাহারও পশ্চাদ্ধাবন করিতেছে কিম্বা বিপদের ক্ষেত্ৰ হইতে পলায়ন করিতেছে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। তাহার হাতের আলোটা যেদিকে যাইতেছে, আমিও সেইদিকে ছুটিলাম।
তোরণের মুখে পৌঁছিয়া ব্যোমকেশ সিঁড়ির উপর আলো ফেলিল। আমি তাহার কাছে পৌঁছিয়া দেখিলাম, সিঁড়ি দিয়া একটা লোক ছুটিতে ছুটিতে উপরে আসিতেছে। কাছে আসিলে চিনিলাম-সীতারাম।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘সীতারাম, সিঁড়ি দিয়া কাউকে নামতে দেখেছ?’
সীতারাম বলিল, ‘জী হুজুর, আমি ওপরে আসছিলাম, হঠাৎ একটা লোকের সঙ্গে টক্কর লেগে গেল। আমি তাকে ধরবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু লোকটা হাত ছাড়িয়ে পালাল।’
‘তাকে চিনতে পারলে?’
‘জী না, অন্ধকারে তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু টক্কর লাগবার সময় তার মুখ দিয়ে একটা বুরা জবান বেরিয়ে গিয়েছিল, তা শুনে মনে হল লোকটা ছোট জাতের হিন্দুস্থানী। —কিন্তু কী হয়েছে হুজুর?’
‘তা এখনও ঠিক জানি না। দেখবে এস।’
ফিরিয়া গেলাম। ঘরের সম্মুখে ভাঙা হাঁড়ির টুকরোগুলা পড়িয়া ছিল, ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঐ দ্যাখো। আমি জেগেছিলাম, বাইরে খুব হালকা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভাবলাম, তুমি বুঝি ফিরে এলে। তারপরই দুম করে শব্দ—’
সীতারাম ভাঙা সরার মত একটা টুকরো তুলিয়া আব্ৰাণ গ্রহণ করিল। বলিল, ‘হুজুর, চট্ করে খাটের উপর উঠে বসুন।’
‘কেন? কি ব্যাপার?’
‘সাপ। কেউ সরা-ঢাকা হাঁড়িতে সাপ এনে এইখানে হাঁড়ি আছড়ে ভেঙ্গেছে। আমাকে টর্চ দিন, আমি খুঁজে দেখছি। সাপ কাছেই কোথাও আছে।’
আমরা বিলম্ব না করিয়া খাটের উপর উঠিয়া বসিলাম, কারণ অন্ধকার রাত্রে সাপের সঙ্গে বীরত্ব চলে না। সীতারাম টর্চ লইয়া বাহিরে খুঁজিয়া দেখিতে লাগিল।
লণ্ঠনটা উস্কাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ঈশানবাবুকে কিসের ভয় দেখিয়ে তাড়াবার চেষ্টা হয়েছিল এখন বুঝতে পারছি।’