‘কিন্তু লোকটা কে?’
‘তা এখন বলা শক্ত। বুলাকিলাল হতে পারে, গণপৎ হতে পারে, এমন কি সন্নিসি ঠাকুরও হতে পারেন।’
এই সময় সীতারামের আকস্মিক অট্টহাস্য শুনিতে পাইলাম। সীতারাম গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘হুজুর, এদিকে দেখবেন আসুন। কোনও ভয় নেই।’
সন্তপণে নামিয়া সীতারামের কাছে গেলাম। বাড়ির একটা কোণ আশ্রয় করিয়া বাদামী রঙের সাপ কুণ্ডলী পাকিয়া কিলবিল করিতেছে। সাপটা আহত, তাই পলাইতে পারিতেছে না, তীব্র আলোর তলায় তাল পাকাইতেছে।
সীতারাম হাসিয়া বলিল, ‘ঢাম্না সাপ, হুজুর, বিষ নেই। মনে হচ্ছে কেউ আমাদের সঙ্গে দিল্লাগি করছে।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দিল্লাগিই বটে। কিন্তু এখন সাপটাকে নিয়ে কি করা যাবে?
সাপটকে চাপা দিল, বলিল, ‘আজ এমনি থাক, কাল দেখা যাবে।’
আমরা ঘরে ফিরিয়া আসিলাম। সীতারাম দ্বারের সম্মুখে নিজের বিছানা পাতিতে প্রবৃত্ত হইল। রাত্রি ঠিক দ্বিপ্রহর।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সীতারাম, তুমি এত রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলে, কি করছিলে, এবার বল দেখি।’
সীতারাম বলিল, ‘হুজুর, এখান থেকে নেমে দেউড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি, বুলাকিলাল ভাঙি খেয়ে নিজের কুঠুরির মধ্যে ঘুমুচ্ছে। তার কাছ থেকে কিছু খবর বার করবার ইচ্ছে ছিল, সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গে দোস্তি করে রেখেছিলাম। ঠেলাঠুলি দিলাম। কিন্তু বুলাকিলাল জাগল না। কি করি, ভাবলাম, যাই সাধুবাবার দর্শন করে আসি।
‘সাধুবাবা জেগে ছিলেন, আমাকে দেখে খুশি হলেন। আমাকে অনেক সওয়াল করলেন; আপনারা কে, কি জন্যে এসেছেন, এইসব জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনারা হাওয়া বদল করতে এসেছেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশ বেশ। আর কি কথা হল?’
সীতারাম বলিল, ‘অনেক আজে-বাজে কথা হল হুজুর। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একেবারে প্রোফেসার সাহেবের মৃত্যুর কথা তুললাম, তাতে সাধুবাবা ভীষণ চটে উঠলেন। দেখলাম বাড়ির মালিক আর নায়েববাবুর ওপর ভারি রাগ। বার বার বলতে লাগলেন, ওদের সর্বনাশ হবে, ওদের সর্বনাশ হবে।’
‘তাই নাকি! ভারি অকৃতজ্ঞ সাধু দেখছি। তারপর?’
‘তারপর সাধুবাবা এক ছিলিম গাঁজা চড়ালেন। আমাকে প্রসাদ দিলেন।’
‘তুমি গাঁজা খেলে?’
‘জী হুজুর। সাধুবাবার প্রসাদ তো ফেলে দেওয়া যায় না।’
‘তা বটে। তারপর?’
‘তারপর সাধুবাবা কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমিও চলে এলাম। ফেরবার সময় সিঁড়িতে ঐ লোকটার সঙ্গে ধাক্কা লাগিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা, একটা কথা বল তো সীতারাম। তুমি যখন ফিরে আসছিলে তখন বুলাকিলালকে দেখেছিলে?’
সীতারাম বলিল, ‘না। হুজুর, চোখে দেখিনি। কিন্তু দেউড়ির পাশ দিয়ে আসবার সময় কুঠুরি থেকে তার নাকড়াকার ঘড়ঘড় আওয়াজ শুনেছিলাম।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক, তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাপের হাঁড়ি নিয়ে যিনি এসেছিলেন তিনি আর যেই হোন, বুলাকিলাল কিম্বা সাধুবাবা নন। আশা করি, তিনি আজ আর দ্বিতীয়বার এদিকে আসবেন না-এবার ঘুমিয়ে পড়।’
সকালে উঠিয়া দেখা গেল ঢাকনি-চাপা সাপটা রাত্রে মরিয়া গিয়াছে; বোধহয় হাঁড়ি ভাঙার সময় গুরুতর আঘাত পাইয়াছিল। সীতারাম সেটাকে লাঠির ডগায় তুলিয়া দুর্গপ্রাকারের বাহিরে ফেলিয়া দিল। আমরাও প্রাকারে উঠিয়া একটা চক্ৰ দিলাম। দেখা গেল, প্রাকার একেবারে অটুট নয় বটে কিন্তু তোরণদ্বার ছাড়া দুর্গে প্রবেশ করিবার অন্য কোনও চোরাপথ নাই। প্রাকারের নীচেই অগাধ গভীরতা।
বেলা আন্দাজ আটটার সময় সীতারামকে দুর্গে রাখিয়া ব্যোমকেশ ও আমি রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। রমাপতি সদর বারান্দায় আমাদের অভ্যর্থনা করিল। —‘আসুন। কর্তা এখনি বেরুচ্ছেন, শহরে যাবেন।’
‘তাই নাকি?’ আমরা ইতস্তত করিতেছি এমন সময় রামকিশোরবাবু বাহির হইয়া আসিলেন। পরনে গরদের পাঞ্জাবি, গলায় কোঁচানো চাদর; আমাদের দেখিয়া বলিলেন ‘এই যে!—নতুন জায়গা কেমন লাগছে? রাত্রে বেশ আরামে ছিলেন? কোনও রকম অসুবিধে হয়নি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কোন অসুবিধে হয়নি, ভারি আরামে রাত কেটেছে। আপনি বেরুচ্ছেন?’ ]
‘হ্যাঁ, একবার উকিলের বাড়ি যাব, কিছু দলিলপত্তর রেজিস্ট্রি করাতে হবে। তা—আপনারা এসেছেন, আমি না হয় একটু দেরি করেই যাব–‘
ব্যোমকেশ বলিল, ‘না না, আপনি কাজে বেরুচ্ছেন বেরিয়ে পড়ুন। আমরা এমনি বেড়াতে এসেছি, কোনও দরকার নেই।’
‘তা-আচ্ছা। রমাপতি, এঁদের চা-টা দাও। আমাদের ফিরতে বিকেল হবে।’
রামকিশোর বাহির হইয়া পড়িলেন; জামাই মণিলাল এক বস্তা কাগজপত্ৰ লইয়া সঙ্গে গেল। আমাদের পাশ দিয়া যাইবার সময় মণিলাল সহাস্যমুখে নমস্কার করিল।
ব্যোমকেশ রমাপতিকে বলিল, ‘চায়ের দরকার নেই, আমরা চা খেয়ে বেরিয়েছি। আজই বুঝি সম্পত্তি বাঁটোয়ারার দলিল রেজিষ্টি হবে?
‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’
‘যাক, একটা দুর্ভাবনা মিটুল।–আচ্ছা, বলুন দেখি—’
রমাপতি হাতজোড় করিয়া বলিল, ‘আমাকে ‘আপনি বলবেন না, ‘তুমি’ বলুন।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘বেশ, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, কিন্তু সে পরে হবে। এখন বল দেখি গণপৎ কোথায়?’
রমাপতি একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, ‘গণপৎ-মুরলীদার চাকর? বাড়িতেই আছে নিশ্চয়। আজ সকালে তাকে দেখিনি। ডেকে আনিব?’
এই সময় মুরলীধর বারান্দায় আসিয়া আমাদের দেখিয়া থতিমত খাইয়া দাঁড়াইল। তাহার ট্যারা চোখ আরও ট্যারা হইয়া গেল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনিই মুরলীধরবাবু? নমস্কার। আপনার চাকর গণপৎকে একবার ডেকে দেবেন? তার সঙ্গে একটু দরকার আছে।’