মুরলীধরের মুখ ভয় ও বিদ্রোহের মিশ্রণে অপরূপ ভাব ধারণ করিল। সে চেরা গলায় বলিল, ‘গণপতের সঙ্গে কি দরকার?
‘তাকে দু’ একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’
‘সে-তাকে ছুটি দিয়েছি। সে বাড়ি গেছে।’
‘তাই নাকি! কবে ছুটি দিয়েছেন?’
‘কাল—কাল দুপুরে।’ মুরলীধর আর প্রশ্নোত্তরের অপেক্ষা না করিয়া দ্রুত বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। রমাপতির মুখে একটা ত্ৰস্ত উত্তেজনার ভাব দেখা গেল। সে ব্যোমকেশের কাছে সরিয়া আসিয়া খাটো গলায় বলিল, ‘কাল দুপুরে—! কিন্তু কাল সন্ধ্যের পরও আমি গণপৎকে বাড়িতে দেখেছি।–’
ঘাড় নাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘খুব সম্ভব। কারণ, রাত বারোটা পর্যন্ত গণপৎ বাড়ি যায়নি। কিন্তু সে যাক। নায়েব চাঁদমোহনবাবু বাড়িতে আছেন নিশ্চয়। আমরা তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’
রমাপতি বলিল, ‘তিনি নিজের ঘরে আছেন–’
‘বেশ, সেখানেই আমাদের নিয়ে চল।’
বাড়ির এক কোণে চাঁদমোহনের ঘর। আমরা দ্বারের কাছে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, তিনি দেয়ালের দিকে মুখ করিয়া বসিয়া সারি সারি কলিকায় তামাক সাজিয়া রাখিতেছেন। বোধ করি সারাদিনের কাজ সকালেই সারিয়া লইতেছেন। ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া রমাপতিকে বিদায় করিল। আমরা ঘরে প্রবেশ করিলম, ব্যোমকেশ দরজা ভেজাইয়া দিল।
আমাদের অতর্কিত আবিভাবে চাঁদমোহন ত্ৰস্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, তাঁহার চতুর চোখে চকিত ভয়ের ছায়া পড়িল। তিনি বলিয়া উঠিলেন, ‘কে? অ্যাঁ–ও-আপনারা—!’
ব্যোমকেশ তক্তপোশের কোণে বসিয়া বলিল, ‘চাঁদমোহনবাবু্, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’ তাহার কণ্ঠস্বর খুব মোলায়েম শুনাইল না।
ত্রাসের প্রথম ধাক্কা সামলাইয়া লইয়া চাঁদমোহন গামছায় হাত মুছিতে মুছিতে বলিলেন, ‘কি
কথা?’
‘অনেক দিনের পুরোনো কথা। রামবিনোদের মৃত্যু হয় কি করে?’
চাঁদমোহনের মুখ শীর্ণ হইয়া গেল, তিনি ক্ষণেক নীরব থাকিয়া অৰ্ধক্ষুট স্বরে বলিলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারি না–আমি এ বাড়ির নায়েব—’
ব্যোমকেশ গম্ভীর স্বরে বলিল, ‘চাঁদমোহনবাবু্, আপনি আমার নাম জানেন; আমার কাছে কোনও কথা লুকোবার চেষ্টা করলে তার ফল ভাল হয় না। রামবিনোদের মৃত্যুর সময় আপনি উপস্থিত ছিলেন তার প্রমাণ আছে। কি করে তাঁর মৃত্যু হল সব কথা খুলে বলুন।’
চাঁদমোহন ব্যোমকেশের দিকে একটা তীক্ষ্ণ চোরা চাহনি হানিয়া ধীরে ধীরে তক্তপোশের একপাশে আসিয়া বসিলেন, শুষ্কস্বরে বলিলেন, ‘আপনি যখন জোর করছেন তখন না বলে আমার উপায় নেই। আমি যতটুকু জানি বলছি।’
ভিজা গামছায় মুখ মুছিয়া তিনি বলিতে আরম্ভ করিলেন’—
‘১৯১১ সালের শীতকালে আমরা মুঙ্গেরে ছিলাম। রামবিনোদ আর রামকিশোরের তখন ঘিয়ের ব্যবসা ছিল, কলকাতায় ঘি চালান দিত। মস্ত ঘিয়ের আড়ৎ ছিল। আমি ছিলাম কর্মচারী, আড়তে বসতাম। ওরা দুই ভাই যাওয়া আসা করত।
‘হঠাৎ একদিন মুঙ্গেরে প্লেগ দেখা দিল। মানুষ মরে উড়কুড় উঠে যেতে লাগল, যারা বেঁচে রইল। তারা ঘর-দের ফেলে পালাতে লাগল। শহর। শূন্য হয়ে গেল। রামবিনোদ আর রামকিশোর তখন মুঙ্গেরে, তারা বড় মুশকিলে পড়ল। আড়তে ষাট-সত্তর হাজার টাকার মাল রয়েছে, ফেলে পালানো যায় না; হয়তো সব চোরে নিয়ে যাবে। আমরা তিনজনে পরামর্শ করে। স্থির করলাম, গঙ্গার বুকে নৌকো ভাড়া করে থাকিব, আর পালা করে রোজ একজন এসে আড়ৎ তদারক করে যাব। তারপর কপালে যা আছে তাই হবে। একটা সুবিধে ছিল, আড়ৎ গঙ্গা থেকে বেশি দূরে নয়।
‘রামবিনোদের এক ছেলেবেলার বন্ধু মুঙ্গেরে স্কুল মাস্টারি করত—ঈশান মজুমদার। ঈশান সেদিন সর্পাঘাতে মারা গেছে। সেও নৌকোয় এসে জুটল। মাঝি মাল্লা নেই, শুধু আমরা চারজন-নীেকোটা বেশ বড় ছিল; নৌকোতেই রান্নাবান্না্্, নৌকোতেই থাকা। গঙ্গার মাঝখানে চড়া পড়েছিল, কখনও সেখানে গিয়ে রাত কাটাতাম। শহরের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল কেবল দিনে একবার গিয়ে আড়ৎ দেখে আসা।
‘এইভাবে দশ বারো দিন কেটে গেল। তারপর একদিন রামবিনোদকে প্লেগে ধরল। শহরে গিয়েছিল জুর নিয়ে ফিরে এল। আমরা চড়ায় গিয়ে নৌকো লোগালাম, রামবিনোদকে চড়ায় নামালাম। একে তো প্লেগের কোনও চিকিৎসা নেই, তার ওপর মাঝ-গঙ্গায় কোথায় ওষুধ্্, কোথায় ডাক্তার। রামবিনোদ পরের দিনই মারা গেল।’
ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘তারপর আপনারা কি করলেন?’
চাঁদমোহন বলিলেন, ‘আর থাকতে সাহস হল না। আড়তের মায়া ত্যাগ করে নীেকো ভাসিয়ে ভাগলপুরে পালিয়ে এলাম।’
‘রামবিনোদের দেহ সৎকার করেছিলেন?’
চাঁদমোহন গামছায় মুখ মুছিয়া বলিলেন, ‘দাহ করবার উপকরণ ছিল না; দেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।’
‘চল, এবার ফেরা যাক। এখানকার কাজ আপাতত শেষ হয়েছে।’
সিঁড়ির দিকে যাইতে যাইতে আমি জিজ্ঞাসা করিলম, ‘কি মনে হল? চাঁদমোহন সত্যি কথা বলেছে?’
‘একটু মিথ্যে বলেছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই।’
সিঁড়ি দিয়ে নামিতে যাইব, দেখিলাম তুলসী অদূরে একটি গাছের ছায়ায় খেলাঘর পাতিয়াছে, একাকিনী খেলায় এমন মগ্ন হইয়া গিয়াছে যে আমাদের লক্ষ্যই করিল না। ব্যোমকেশ কাছে গিয়া দাঁড়াইতে সে বিস্ফারিত চক্ষু তুলিয়া চাহিল। ব্যোমকেশ একটু সমেহ হাসিয়া বলিল, ‘তোমার নাম তুলসী, না? কি মিষ্টি তোমার মুখখানি।’
তুলসী তেমনি অপলক চক্ষে চাহিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা দুর্গে আছি, তুমি আসো না কেন? এসো—অনেক গল্প বলব।’
তুলসী তেমনি তাকাইয়া রহিল, উত্তর দিল না। আমরা চলিয়া আসিলাম।