দুর্গরহস্য

১০

দুর্গে ফিরিয়া কিছুক্ষণ সিঁড়ি ওঠা-নামার ক্লান্তি দূর করিলম। ব্যোমকেশ সিগারেট ধরাইয়া বলিল‌, ‘রামকিশোরবাবু দলিল রেজিস্ট্রি করতে গেলেন। যদি হয়ে যায়‌, তাহলে ওদের বাড়িতে একটা নাড়াচাড়া তোলাপাড়া হবে; বংশী আর মুরলীধর হয়তো শহরে গিয়ে বাড়ি-ভাড়া করে থাকতে চাইবে। তার আগেই এ ব্যাপারের একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাওয়া দরকার।’

প্রশ্ন করিলম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, কিছু বুঝছ? আমি তো যতাই দেখছি‌, ততাই জট পাকিয়ে যাচ্ছে।’ ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটা আবছায়া চলচ্চিত্রের ছবি মনের পদায় ফুটে উঠছে। ছবিটা ছোট নয়; অনেক মানুষ অনেক ঘটনা অনেক সংঘাত জড়িয়ে তার রূপ। একশ বছর আগে এই নাটকের অভিনয় শুরু হয়েছিল‌, এখনও শেষ হয়নি।–ভাল কথা‌, কাল রাত্রের আলগা পাথরটার কথা মনে ছিল না। চল‌, দেখি গিয়ে তার তলায় গর্ত আছে কি না।’

‘চল।’

পাথরটার উপর অল্প-অল্প চুন সুরকি জমাট হইয়া আছে‌, আশেপাশের পাথরগুলির মত মসৃণ নয়। ব্যোমকেশ দেখিয়া বলিল‌, ‘মনে হচ্ছে পাথরটাকে তুলে আবার উল্টো করে বসানো হয়েছে। এসো‌, তুলে দেখা যাক।’

আমরা আঙুল দিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলম‌, কিন্তু পাথর উঠিল না। তখন সীতারামকে ডাকা হইল। সীতারাম করিতকমা লোক‌, সে একটা খুন্তি আনিয়া চাড়া দিয়া পাথর তুলিয়া ফেলিল।

পাথরের নীচে গর্তটর্ত কিছু নাই‌, ভরাট চুন সুরকি। ব্যোমকেশ পাথরের উল্টা পিঠ পরীক্ষা করিয়া বলিল‌, ‘ওহে‌, এই দ্যাখো‌, উর্দু-ফারসী লেখা রয়েছে!’

দেখিলাম পাথরের উপর কয়েক পংক্তি বিজাতীয় লিপি খোদাই করা রহিয়াছে। খোদাই খুব গভীর নয়‌, উপরন্তু লেখার উপর ধূলাবালি জমিয়া প্রায় অলক্ষণীয় হইয়া পড়িয়াছে। ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল‌, ‘আমার মনে হচ্ছে—। দাঁড়াও‌, ঈশানবাবুর খাতাটা নিয়ে আসি।’

ঈশানবাবুর খাতা ব্যোমকেশ নিজের কাছে রাখিয়াছিল। সে তাহা আনিয়া যে-পাতায় ফারসী লেখা ছিল‌, তাহার সহিত পাথরের উৎকীর্ণ লেখাটা মিলাইয়া দেখিতে লাগিল। আমিও দেখিলাম। অর্থবোধ হইল না বটে‌, কিন্তু দু’টি লেখার টান যে একই রকম তাহা সহজেই চোখে পড়ে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হয়েছে। এবার চল।’

পাথরটি আবার যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়া আমরা ঘরে আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ব্যাপার বুঝলে?’

‘তুমি পরিষ্কার করে বল।’

‘একশ বছর আগের কথা স্মরণ কর। সিপাহীরা আসছে শুনে রাজারাম তাঁর পরিবারবর্গকে সরিয়ে দিলেন‌, দুর্গে রইলেন কেবল তিনি আর জয়রাম। তারপর বাপবোঁটায় সমস্ত ধনরত্ন লুকিয়ে ফেললেন।

‘কিন্তু সোনাদানা লুকিয়ে রাখার পর রাজারামের ভয় হল‌, সিপাহীদের হাতে তাঁরা যদি মারা পড়েন‌, তাহলে তাঁদের স্ত্রী-পরিবার সম্পত্তি উদ্ধার করবে কি করে? তিনি পাথরের উপর সঙ্কেত-লিপি লিখলেন; এমন ভাষায় লিখলেন যা সকলের আয়ত্ত নয়। তারপর ধুলোেকাদা দিয়ে লেখাটা অস্পষ্ট করে দিলেন‌, যাতে সহজে সিপাহীদের নজরে না পড়ে।

‘সিপাহীরা এসে কিছুই খুঁজে পেল না। রাগে তারা বাপবেটাকে হত্যা করে চলে গেল। তারপর রাজারামের পরিবারবগ যখন ফিরে এল‌, তারাও খুঁজে পেল না। রাজারাম কোথায় তাঁর ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে গেছেন। পাথরের পার্টিতে খোদাই করা ফারসী সঙ্কেত-লিপি কারুর চোখে পড়ল না।’

বলিলাম‌, তাহলে তোমার বিশ্বাস‌, রাজারামের ধনরত্ন এখনও দুৰ্গে লুকোনো আছে।’

‘তাই মনে হয়। তবে সিপাহীরা যদি রাজারাম আর জয়রামকে যন্ত্রণা দিয়ে গুপ্তস্থানের সন্ধান বার করে নিয়ে থাকে তাহলে কিছুই নেই।’

‘তারপর বল।’

‘তারপর একশ বছর পরে এলেন অধ্যাপক ঈশান মজুমদার। ইতিহাসের পণ্ডিত ফারসী-জোনা লোক; তার ওপর বন্ধু রামবিনোদের কাছে দুর্গের ইতিবৃত্ত শুনেছিলেন। তিনি সন্ধান করতে আরম্ভ করলেন; প্রকাশ্যে নয়‌, গোপনে। তাঁর এই গুপ্ত অনুসন্ধান কতদূর এগিয়েছিল জানি না‌, কিন্তু একটা জিনিস তিনি পেয়েছিলেন-ঐ পাথরে খোদাই করা সঙ্কেত-লিপি। তিনি সযত্নে তার নকল খাতায় টুকে রেখেছিলেন‌, আর পাথরটাকে উল্টে বসিয়েছিলেন‌, যাতে আর কেউ না দেখতে পায়। তারপর-তারপর যে কী হল সেইটেই আমাদের আবিষ্কার করতে হবে।’

ব্যোমকেশ খাটের উপর চিৎ হইয়া শুইয়া উর্ধের্ব চাহিয়া রহিল। আমিও আপন মনে এলোমেলো চিস্তা করিতে লাগিলাম। পাণ্ডেজি এবেলা বোধহয় আসিলেন না। …কলিকাতায় সত্যবতীর খবর কি.ব্যোমকেশ হঠাৎ তুলসীর সহিত এমন সস্নেহে কথা বলিল কেন? মেয়েটার চৌদ্দ বছর বয়স‌, দেখিলে মনে হয় দশ বছরেরটি…

দ্বারের কাছে ছায়া পড়িল। ঘাড় ফিরাইয়া দেখি‌, তুলসী আর গদাধর। তুলসীর চোখে শঙ্কা ও আগ্রহ‌, বোধহয় একা আসিতে সাহস করে নাই‌, তাই গদাধরকে সঙ্গে আনিয়াছে। গদাধরের কিন্তু লেশমাত্র শঙ্কা-সঙ্কোচ নাই; তাহার হাতে লাট্টু‌, মুখে কান-এঁটো-করা হাসি। আমাকে দেখিয়া হাস্য সহকারে বলিল‌, ‘হে হে জামাইবাবুর সঙ্গে তুলসীর বিয়ে হবে-হে হে হে–’

তুলসী বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া তাহার গালে একটি চড় বসাইয়া দিল। গদাধর ক্ষণেক গাল ফুলাইয়া দাঁড়াইয়া রহিল‌, তারপর গভীরমুখে লাটুতে লেক্তি পাকাইতে পাকাইতে প্ৰস্থান করিল। বুঝিলাম ছোট বোনের হাতে চড়-চাপড় খাইতে সে অভ্যস্ত।

তুলসীকে ব্যোমকেশ আদর করিয়া ঘরের মধ্যে আহ্বান করিল‌, তুলসী কিন্তু আসিতে চায় না‌, দ্বারের খুঁটি ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ব্যোমকেশ তখন তাহাকে হাত ধরিয়া আনিয়া খাটের উপর বসাইয়া দিল।

তবু তুলসীর ভয় ভাঙে না‌, ব্যাধশঙ্কিত হরিণীর মত তার ভাবভঙ্গী। ব্যোমকেশ নরম সুরে সমবয়স্কের মত তাহার সহিত গল্প করিতে আরম্ভ করিল। দুটা হাসি তামাসার কথা‌, মেয়েদের খেলাধুলা পুতুলের বিয়ে প্রভৃতি মজার কাহিনী্‌,–শুনিতে শুনিতে তুলসীর ভয় ভাঙিল। প্রথমে দু’ একবার ‘হুঁ’ ‘না’‌, তারপর সহজভাবে কথা বলিতে আরম্ভ করিল।

0 Shares