মিনিট পনরোর মধ্যে তুলসীর সঙ্গে আমাদের সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হইল। দেখিলাম তাহার মন সরল, বুদ্ধি সতেজ; কেবল তাহার স্নায়ু সুস্থ নয়; সামান্য কারণে স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়া সহজতর মাত্রা ছাড়াইয়া যায়। ব্যোমকেশ তাহার চরিত্র ঠিক ধরিয়াছিল। তাই সমেহ ব্যবহারে তাহাকে আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে।
তুলসীর সহিত আমাদের যে সকল কথা হইল, তাহা আগাগোড়া পুনরাবৃত্তি করিবার প্রয়োজন নাই, তাহাদের পরিবার সম্বন্ধে এমন অনেক কথা জানা গেল যাহা পূর্বেই লিপিবদ্ধ হইয়াছে। বাকিগুলি লিপিবদ্ধ করিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখানে এসে যিনি ছিলেন, তোমার বাবার বন্ধু ঈশানবাবু্, তাঁর সঙ্গে তোমার ভাব হয়েছিল?
তুলসী বলিল, ‘হ্যাঁ। তিনি আমাকে কত গল্প বলতেন। রাত্তিরে তাঁর ঘুম হত না; আমি অনেক বার দুপুর রাত্তিরে এসে তাঁর কাছে গল্প শুনেছি।’
‘তাই নাকি! তিনি যে-রাত্তিরে মারা যান সে-রাত্তিরে তুমি কোথায় ছিলে?’
‘সো-রাত্তিরে আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।’
‘ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল! সে কি!’
‘হ্যাঁ। আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই কিনা, তাই ওরা সুবিধে পেলেই আমাকে বন্ধ করে রাখে।’
‘ওরা কারা?’
‘সবাই। বাবা বড়দা মেজদা জামাইবাবু–’
‘সে-রাত্তিরে কে তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?’
‘বাবা।’
‘হুঁ। আর কাল রাত্ৰে বুঝি মেজদা তোমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল?’
‘হ্যাঁ-তুমি কি করে জানলে?’
‘আমি সব জানতে পারি। আচ্ছা, আর একটা কথা বল দেখি। তোমার বড়দার বিয়ে হয়েছিল, বৌদিদিকে মনে আছে?’
‘কেন থাকবে না? বৌদিদি খুব সুন্দর ছিল। দিদি তাকে ভারি হিংসে করত।’
‘তাই নাকি! তা তোমার বৌদিদি আত্মহত্যা করল কেন?’
‘তা জানি না। সে-রাত্তিরে দিদি আমাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল।’
‘ও–’
ব্যোমকেশ আমার সহিত একটা দৃষ্টি বিনিময় করিল। কিছুক্ষণ অন্য কথার পর ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা তুলসী, বল দেখি বাড়ির মধ্যে তুমি কাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসো?’
তুলসী নিঃসঙ্কোচে অলজ্জিত মুখে বলিল, ‘মাস্টার মশাইকে। উনিও আমাকে খুব ভালবাসেন।’
‘আর মণিলালকে তুমি ভালবাসো না?’
তুলসীর চোখ দুটা যেন দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল—‘না। ও কেন মাস্টার মশাইকে হিংসে করে! ও কোন মাস্টার মশাইয়ের নামে বাবার কাছে লাগায়? ও যদি আমাকে বিয়ে করে আমি ওকে পাহাড় থেকে ঠেলে ফেলে দেব।’ বলিয়া তুলসী ছুটিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমরা দুই বন্ধু পরস্পর মুখের পানে চাহিয়া রহিলাম। শেষে ব্যোমকেশ একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, ‘বেচারি’
আধা ঘন্টা পরে স্নানের জন্য উঠি-উঠি করিতেছি, রমাপতি আসিয়া দ্বারে উঁকি মারিল, কুষ্ঠিত স্বরে বলিল, ‘তুলসী এদিকে এসেছিল না কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, এই খানিকক্ষণ হল চলে গেছে। এস-বোসো।’
রমাপতি সঙ্কুচিতভাবে আসিয়া বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘রমাপতি, প্রথম যেদিন আমরা এখানে আসি, তুমি বলেছিলে এবার ঈশানবাবুর মৃত্যু-সমস্যার সমাধান হবে। অথাৎ, তুমি মনে কর ঈশানবাবুর মৃত্যুর একটা সমস্যা আছে। কেমন?’
রমাপতি চুপ করিয়া রহিল। ব্যোমকেশ বলিল, ‘ধরে নেওয়া যাক ঈশানবাবুর মৃত্যুটা রহস্যময়, কেউ তাকে খুন করেছে। এখন আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি তার সোজাসুজি উত্তর দাও। সঙ্কোচ কোরো না। মনে কর তুমি আদালতে হলফ নিয়ে সাক্ষী দিচ্ছ।’
রমাপতি ক্ষীণ স্বরে বলিল, ‘বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাড়ির সকলকেই তুমি ভাল করে চেনো। বল দেখি, ওদের মধ্যে এমন কে মানুষ আছে যে খুন করতে পারে?’
রমাপতি সভয়ে কিয়াৎকাল নীরব থাকিয়া কম্পিত কণ্ঠে বলিল, ‘আমার বলা উচিত নয়, আমি ওঁদের আশ্রিত। কিন্তু অবস্থায় পড়লে বোধহয় সবাই মানুষ খুন করতে পারেন।’
‘সবাই? রামকিশোরবাবু?’
‘হ্যাঁ।’
‘বংশীধর?’
‘হ্যাঁ।’
‘মুরলীধর?
‘হ্যাঁ। ওঁদের প্রকৃতি বড় উগ্র—’
‘নায়েব চাঁদমোহন?’
‘বোধহয় না। তবে কর্তার হুকুম পেলে লোক লাগিয়ে খুন করাতে পারেন।’
‘মণিলাল?’
রমাপতির মুখ অন্ধকার হইল, সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, ‘নিজের হাতে মানুষ খুন করবার সাহস ওঁর নেই। উনি কেবল চুকলি খেয়ে মানুষের অনিষ্ট করতে পারেন।’
‘আর তুমি? তুমি মানুষ খুন করতে পার না?’
‘আমি–’
‘আচ্ছা, যাক।–তুমি টর্চ চুরি করেছিলে?’
রমাপতি তিক্তমুখে বলিল, ‘আমার বদনাম হয়েছে জানি। কে বদনাম দিয়েছে তাও জানি। কিন্তু আপনিই বলুন, যদি চুরিই করতে হয়, একটা সামান্য টর্চ চুরি করব।’
‘অর্থাৎ চুরি করনি। —যাক, মণিলালের সঙ্গে তুলসীর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তুমি জানো?’
রমাপতির মুখ কঠিন হইয়া উঠিল। কিন্তু সে সংযতভাবে বলিল, ‘জানি। কর্তার তাই ইচ্ছে।’
‘আর কারুর ইচ্ছে নয়?’
‘না।’
‘তোমারও ইচ্ছে নয়?’
রমাপতি উঠিয়া দাঁড়াইল,–‘আমি একটা গলগ্ৰহ, আমার ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় কী আসে যায়। কিন্তু এ বিয়ে যদি হয়, একটা বিশ্ৰী কাণ্ড হবে।’ বলিয়া আমাদের অনুমতির অপেক্ষা না করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ দ্বারের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘ছোকরার সাহস আছে!’
১১
বৈকালে সীতারাম চা লইয়া আসিলে ব্যোমকেশ তাহাকে বলিল, ‘সীতারাম, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। বছর দুই আগে একদল বেদে এসে এখানে তাঁবু ফেলে ছিল। তোমাকে বুলাকিলালের কাছে খবর নিতে হবে, বাড়ির কে কে বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত–এ বিষয়ে যত খবর পাও যোগাড় করবে।’
সীতারাম বলিল, ‘জী হুজুর। বুলাকিলাল এখন বাবুদের নিয়ে শহরে গেছে, ফিরে এলে খোঁজ নেব।’