সীতারাম প্রস্থান করিলে বলিলাম, ‘বেদে সম্বন্ধে কৌতুহল কেন?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বিষ! সাপের বিষ কোথেকে এল খোঁজ নিতে হবে না?’
‘ও—’
এই সময় পাণ্ডেজি উপস্থিত হইলেন। তাঁহার কাঁধ হইতে চামড়ার ফিতায় বাইনাকুলার বুলিতেছে। ব্যোমকেশ বলিল, ‘একি; দূরবীন কি হবে?’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আনিলাম। আপনার জন্যে, যদি কাজে লাগে।–সকলে আসতে পারিনি, কাজে আটকে পড়েছিলাম। তাই এবেলা সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় আসতে আসতে দেখি রামকিশোরবাবুও শহর থেকে ফিরছেন। তাঁদের ইঞ্জিন বিগড়েছে, বুলাকিলাল হুইল ধরে বসে আছে, রামকিশোরবাবু গাড়ির মধ্যে বসে আছেন, আর জামাই মণিলাল গাড়ি ঠেলছে।’
‘তারপর?’
‘দড়ি দিয়ে বেঁধে গাড়ি টেনে নিয়ে এলাম।’
‘ওঁদের আদালতের কাজকর্মচুকে গেল?’
‘না, একটু বাকি আছে, কাল আবার যাবেন। —তারপর, নতুন খবর কিছু আছে নাকি?’
‘অনেক নতুন খবর আছে।’
খবর শুনিতে শুনিতে পাণ্ডেজি উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন। বিবৃতি শেষ হইলে বলিলেন, আর সন্দেহ নেই। ঈশানবাবু তোষাখানা খুঁজে বার করেছিলেন, তাই তাঁকে কেউ খুন করেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে খুন করতে পারে?
ব্যোমকেশ বলিল, ‘রামকিশোরবাবু থেকে সন্নিসি ঠাকুর পর্যন্ত সবাই খুন করতে পারে। কিন্তু এটাই একমাত্র প্রশ্ন নয়। আরও প্রশ্ন আছে।’
‘যেমন?’
‘যেমন, বিষ এল কোথেকে। সাপের বিষ তো যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। তারপর ধরুন, সাপের বিষ শরীরে ঢ়োকবার জন্যে এমন একটা যন্ত্র চাই যেটা ঠিক সাপের দাঁতের মত দাগ রেখে যায়।’
‘হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ-?’
‘ইনজেকশনের ছুঁচের দাগ খুব ছোট হয়, দু’চার মিনিটের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। আপনি ঈশানবাবুর পায়ে দাগ দেখেছেন, ইনজেকশানের দাগ বলে মনে হয় কি?’
‘উহুঁ। তাছাড়া, দুটো দাগ পাশাপাশি—’
‘ওটা কিছু নয়। যেখানে রুগী অজ্ঞান হয়ে পড়েছে সেখানে পাশাপাশি দু’বার ছুচ ফোটানো শক্ত কি?’
‘তা বটে।–আর কি প্রশ্ন?’
আর, ঈশানবাবু যদি গুপ্ত তোষাখানা খুঁজে বার করে থাকেন তবে সে তোষাখানা কোথায়?’
‘এই দুর্গের মধ্যেই নিশ্চয় আছে।’
‘শুধু দুর্গের মধ্যেই নয়, এই বাড়ির মধ্যেই আছে। মুরলীধর যে সাপের ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াবার চেষ্টা করছে, তার কারণ কি?’
পাণ্ডেজি তীক্ষা চক্ষে চাহিলেন, ‘মুরলীধর?’ ব্যোমকেশ বলিল, ‘তার অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে। মোট কথা, ঈশানবাবু আসবার আগে তোষাখানার সন্ধান কেউ জানত না। তারপর ঈশানবাবু ছাড়া আর একজন জানতে পেরেছে এবং ঈশানবাবুকে খুন করেছে। তবে আমার বিশ্বাস, মাল সরাতে পারেনি।’
‘কি করে বুঝলেন?’
‘দেখুন, আমরা দুর্গে আছি, এটা কারুর পছন্দ নয়। এর অর্থ কি?’
‘বুঝেছি। তাহলে আগে তোষাখানা খুঁজে বার করা দরকার। কোথায় তোষাখানা থাকতে পারে; আপনি কিছু ভেবে দেখেছেন কি?’
ব্যোমকেশ একটু হাসিল, বলিল, ‘কাল থেকে একটা সন্দেহ আমার মনের মধ্যে ঘুরছে—’
আমি বলিলাম, ‘গজাল!’
এই সময় সীতারাম চায়ের পাত্রগুলি সরাইয়া লইতে আসিল। ব্যোমকেশ তাহার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘বুলাকিলাল ফিরে এসেছে।’
সীতারাম মাথা ঝুঁকাইয়া পাত্রগুলি লইয়া চলিয়া গেল। পাণ্ডে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ওকে কোথাও পাঠালেন নাকি?’
‘হ্যাঁ, বুলাকিলালের কাছে কিছু দরকার আছে।’
‘যাক। এবার আপনার সন্দেহের কথা বলুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঐ গজালগুলো। কেবল সন্দেহ হচ্ছে ওদের প্রকাশ্য প্রয়োজনটাই একমাত্র প্রয়োজন নয়, যাকে বলে ধোঁকার টাটি, ওরা হচ্ছে তাই।’
পাণ্ডে গজালগুলিকে নিরীক্ষণ করিতে করিতে বলিলেন, ‘হুঁ। তা কি করা যেতে পারে।’
‘আমার ইচ্ছে ওদের একটু নেড়েচেড়ে দেখা। আপনি এসেছেন, আপনার সামনেই যা কিছু করা ভাল। যদি তোষাখানা বেরোয়, আমরা তিনজনে জানিব, আর কাউকে আপাতত জানতে দেওয়া হবে না।–অজিত, দরজা বন্ধ কর।’
দরজা বন্ধ করিলে ঘর অন্ধকার হইল। তখন লণ্ঠন জ্বালিয়া এবং টর্চের আলো ফেলিয়া আমরা অনুসন্ধান আরম্ভ করিলম। সর্বসুদ্ধ পনরোটি গজাল। আমরা প্রত্যেকটি টানিয়া ঠেলিয়া উঁচু দিকে আকর্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। গজালগুলি মরিচা-ধরা কিন্তু বজের মত দৃঢ়্্, একচুলও নড়িল না।
হঠাৎ পাণ্ডে বলিয়া উঠিলেন, ‘এই যে! নড়ছে-একটু একটু নড়ছে–!’ আমরা ছুটিয়া তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলাম। দরজার সামনে যে দেয়াল, তাহার মাঝখানে একটা গজাল। পাণ্ডে গজাল ধরিয়া ভিতর দিকে ঠেলা দিতেছেন; নড়িতেছে কিনা আমরা বুঝিতে পারিলাম না। পাণ্ডে বলিলেন, ‘আমার একার কর্ম নয়। ব্যোমকেশবাবু্, আপনিও ঠেলুন।’
ব্যোমকেশ হাঁটু গাড়িয়া দুই হাতে পাথরে ঠেলা দিতে শুরু করিল। চতুষ্কোণ পাথর ধীরে ধীরে পিছন দিকে সরিতে লাগিল। তাহার নীচে অন্ধকার গর্ত দেখা গেল।
আমি টর্চের আলো ফেলিলাম। গর্তটি লম্বা-চওড়ায় দুই হাত, ভিতরে একপ্রস্থ সরু সিঁড়ি নামিয়া গিয়াছে।
পাণ্ডে মহা উত্তেজিতভাবে কপালের ঘাম মুছিয়া বলিলেন, ‘শাবাশ! পাওয়া গেছে তোষাখানা। —ব্যোমকেশবাবু্, আপনি আবিষ্কর্তা, আপনি আগে ঢুকুন।’
টর্চ লইয়া ব্যোমকেশ আগে নামিল, তারপর পাণ্ডেজি, সর্বশেষে লণ্ঠন লইয়া আমি।। ঘরটি উপরের ঘরের মতাই প্রশস্ত। একটি দেওয়ালের গা ঘেষিয়া সারি সারি মাটির কুণ্ডা। কুণ্ডার মুখ ছোট ছোট হাঁড়ি, হাঁড়ির মুখ সারা দিয়া ঢাকা।। ঘরের অন্য কোণে একটি বড় উনান, তাহার সহিত একটি হাপরের নল সংযুক্ত রহিয়াছে। হাপরের চামড়া অবশ্য শুকাইয়া ঝরিয়া গিয়াছে, কিন্তু কাঠামো দেখিয়া হাপর বলিয়া চেনা যায়। ঘরে আর কিছু নাই।