দুর্গরহস্য

আমাদের ঘন ঘন নিশ্বাস পড়িতেছিল‌, পেট মোটা কুণ্ডাগুলিতে না জানি কোন রাজার সম্পত্তি রহিয়াছে। কিন্তু আগে ঘরের অন্যান্য স্থান দেখা দরকার। এদিক-ওদিক আলো ফেলিতে এককোণে একটা চকচকে জিনিস চোখে পড়িল। ছুটিয়া কাছে গিয়া দেখি-একটি ছোট বৈদ্যুতিক টর্চ। তুলিয়া লইয়া জ্বালাইবার চেষ্টা করিলম‌, কিন্তু টর্চ জ্বালাই ছিল‌, জ্বলিয়া জ্বলিয়া সেল ফুরাইয়া নিভিয়া গিয়াছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ঈশানবাবু যে এ ঘরের সন্ধান পেয়েছিলেন‌, তার অকাট্য প্রমাণ।’।

তখন আমরা হাঁড়িগুলি খুলিয়া দেখিলাম। সব হাঁড়িই শূন্য‌, কেবল একটা হাঁড়ির তলায় নুনের মত খানিকটা গুড়া পড়িয়া আছে। ব্যোমকেশ একখামচা তুলিয়া লইয়া পরীক্ষা করিল‌, তারপর রুমালে বাঁধিয়া পকেটে রাখিল। বলিল‌, নুন হতে পারে‌, চুন হতে পারে‌, অন্য কিছুও হতে পারে।’

অতঃপর কুণ্ডাগুলি একে একে পরীক্ষা করা হইল। কিন্তু হায় সাত রাজার ধন মিলিল না। সব কুণ্ডা খালি‌, কোথাও একটা কপর্দক পর্যন্ত নাই।

কিন্তু কিছু মিলিল না।

উপরে ফিরিয়া আসিয়া প্ৰথমে গুপ্তদ্বার টানিয়া বন্ধ করা হইল। তারপর ঘরের দরজা খুলিলাম। বাহিরে অন্ধকার হইয়া গিয়াছে; সীতারাম দ্বারের বাহিরে ঘোরাঘুরি করিতেছে। ব্যোমকেশ ক্লান্তিস্বরে বলিল‌, ‘সীতারাম‌, আর একদফা চা তৈরি কর।’

চেয়ার লইয়া তিনজনে বাহিরে বসিলাম। পাণ্ডে দমিয়া গিয়াছিলেন‌, বলিলেন‌, ‘কি হল বলুন দেখি? মাল গেল কোথায়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে। এক‌, সিপাহীরা সব লুটে নিয়ে গিয়েছে। দুই‌, ঈশানবাবুকে যে খুন করেছে‌, সে সেই রাত্রেই মাল সরিয়েছে। তিন‌, রাজারাম অন্য কোথাও মাল লুকিয়েছেন।’

‘কোন সম্ভাবনাটা আপনার বেশি মনে লাগে?’ ব্যোমকেশ হাত নাড়িয়া বিলাকা’ কবিতার শেষ পংক্তি আবৃত্তি করিল‌, ‘হেথা নয়‌, অন্য কোথা‌, অন্য কোথা‌, অন্য কোনখানে।’

চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ সীতারামকে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘বুলাকিলালের দেখা পেলে?’

সীতারাম বলিল‌, ‘জী। গাড়ির ইঞ্জিন মেরামত করছিল‌, দু-চারটে কথা হল।’

‘কি বললে সে?’

‘হুজুর‌, বুলাকিলাল একটা আস্ত বুদ্ধ। সন্ধ্যে হলেই ভাঙি খেয়ে বেদম ঘুমোয়‌, রাত্তিরের কোনও খবরই রাখে না। তবে দিনের বেলা বাড়ির সকলেই বেদের তাঁবুতে যাতায়াত করত। এমনকি‌, বুলাকিলোলও দু-চারবার গিয়েছিল।’

‘বুলাকিলাল গিয়েছিল কেন?’

‘হাত দেখাতে। বেদেনীরা নাকি ভাল হাত দেখতে জানে‌, ভূত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। বুলাকিলালকে বলেছে ও শীগগির লাট সাহেবের মোটর ড্রাইভার হবে।’

‘বাড়ির আর কে কে যেতো?’

‘মালিক‌, মালিকের দুই বড় ছেলে‌, জামাইবাবু্‌, নায়েববাবু্‌, সবাই যেতো। আর ছোট ছেলেমেয়ে দুটো সর্বদাই ওখানে ঘোরাঘুরি করত।’

‘হুঁ, আর কিছু?’

‘আর কিছু নয় হুজুর।’

রাত্রি হইতেছে দেখিয়া পাণ্ডেজি উঠিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে রুমালে বাঁধা পুঁটুলি দিয়া বলিল‌, ‘এটার কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করিয়ে দেখবেন। আমরা এ পর্যন্ত যতটুকু খবর সংগ্ৰহ করেছি। তাতে নিরাশ হবার কিছু নেই। অন্তত ঈশানবাবুকে যে হত্যা করা হয়েছে‌, এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ‌, বাকি খবর ক্রমে পাওয়া যাবে।’

পাণ্ডেজি রুমালের পুঁটুলি পকেটে রাখিতে গিয়া বলিলেন‌, ‘আরে‌, ডাকে আপনার একটা চিঠি এসেছিল‌, সেটা এতক্ষণ দিতেই ভুলে গেছি। এই নিন।–আচ্ছা‌, কাল আবার আসব।’

পাণ্ডেজিকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া বসিলাম। ব্যোমকেশ চিঠি খুলিয়া পড়িল‌, জিজ্ঞাসা করিলম‌, সত্যবতীর চিঠি নাকি?’

‘না‌, সুকুমারের চিঠি।’

‘কি খবর?’

‘নতুন খবর কিছু নেই। তবে সব ভাল।’

১২

রাত্রিটা নিরুপদ্রবে কাটিয়া গেল।

পরদিন সকালে ব্যোমকেশ ঈশানবাবুর খাতা লইয়া বসিল। কখনও খাতাটা পড়িতেছে‌, কখনও ঊর্ধ্বপানে চোখ তুলিয়া নিঃশব্দে ঠোঁট নাড়িতেছে‌, কথাবার্তা বলিতেছে না।

বলিলাম‌, ‘কিসের গবেষণা হচ্ছে?’

ব্যোমকেশ সংক্ষেপে বলিল‌, ‘মোহনলাল।’

মোহনলালের নামে আজ‌, কেন জানি না‌, বহুদিন পূর্বে পঠিত ‘পলাশীর যুদ্ধ মনে পড়িয়া গেল। বলিলাম‌, ‘আবার আবার সেই কামান গর্জন…কাঁপাইয়া গঙ্গাজল–’

ব্যোমকেশ ভর্ৎসনা-ভরা চক্ষু তুলিয়া আমার পানে চাহিল। আমি বলিলাম‌, ‘দাঁড়ারে দাঁড়ারে ফিরে দাঁড়ারে যবন‌, গৰ্জিল মোহনলাল নিকট শমন।’

ব্যোমকেশের চোখের ভর্ৎসনা ক্রমে হিংস্র ভাব ধারণ করিতেছে দেখিয়া আমি ঘর ছাড়িয়া চলিয়া আসিলাম। কেহ যদি বীররসাত্মক কাব্য সহ্য করিতে না পারে‌, তাহার উপর জুলুম করা উচিত নয়।

বাহিরে স্বণেজ্জ্বিল হৈমন্ত প্রভাত। দূরবীনটা হাতেই ছিল‌, আমি সেটা লইয়া প্রাকারে উঠিলাম। চারিদিকের দৃশ্য অতি মনোরম। দূরের পর্বতচূড়া কাছে আসিয়াছে‌, বনানীর মাথার উপর আলোর ঢেউ খেলিতেছে। ঘুরিয়া ঘুরিয়া দেখিতে দেখিতে রামকিশোরবাবুর বাড়ির সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিলাম। বাড়ির খুঁটিনাটি সমস্ত দেখিতে পাইতেছি। রামকিশোর শহরে যাইবার জন্য বাহির হইলেন‌, সঙ্গে দুই পুত্র এবং জামাই। তাঁহারা সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেলেন; কিছুক্ষণ পরে মোটর চলিয়া গেল। …বাড়িতে রহিল মাস্টার রমাপতি‌, গদাধর। আর তুলসী।

ঝুঁকিয়া খাতা পড়িতেছে‌, আবার উঁচু দিকে মুখ তুলিয়া আপন মনে বিজ বিজ করিতেছে। বলিলাম‌, ‘ওহে‌, রামকিশোরবাবুরা শহরে চলে গেলেন।’

ব্যোমকেশ আমার কথায় কৰ্ণপাত না করিয়া মুরগীর মত জল পান করিতে লাগিল। তারপর হঠাৎ বলিল‌, ‘মোহনলাল মস্ত বীর ছিল–না?’

0 Shares