দুর্গরহস্য

‘সেই রকম তো শুনতে পাই।’

ব্যোমকেশ আর কথা কহিল না। তাহার ভাবগতিক দেখিয়া মনে হইল‌, সে আজ খাতা ছাড়িয়া উঠিবে না। সকালবেলাটা নিক্রিয়ভাবে কাটিয়া যাইবে ভাবিয়া বলিলাম‌, চল না‌, সাধু-দৰ্শন করা যাক। তিনি হয়তো হাত গুনতে জানেন।’

অন্যমনস্কভাবে চোখ তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এখন নয়‌, ওবেলা দেখা যাবে।’

দুপুরবেলা শয্যায় শুইয়া তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় খানিকটা সময় কাটিয়া গেল। রামকিশোরবাবু ঠিক বলিয়ছিলেন; এই নির্জনে দুদিন বাস করিলে প্ৰাণ পালাই-পালাই করে।

পৌঁনে তিনটা পর্যন্ত বিছানায় এপাশি-ওপাশ করিয়া আর পারা গেল না‌, উঠিয়া পড়িলাম। দেখি‌, ব্যোমকেশ ঘরে নাই। বাহিরে আসিয়া দেখিলাম‌, সে প্রাকারের উপর উঠিয়া পায়চারি করিতেছে। রৌদ্র তেমন কড়া নয় বটে‌, কিন্তু এ সময় প্রাকারের উপর বায়ু সেবনের অর্থ হৃদয়ঙ্গম হইল না। তবু হয়তো নূতন কিছু আবিষ্কার করিয়াছে ভাবিয়া আমিও সেই দিকে‌, 5ळेिळ्लभ।

আমাকে দেখিয়া সে যেন নিজের মনের ভিতর হইতে উঠিয়া আসিল‌, যন্ত্রবৎ বলিল‌, ‘একটা তুরপুন চাই।’

‘তুরপুন।’ দেখিলাম‌, তাহার চোখে অধীর বিভ্রান্ত দৃষ্টি। এ-দৃষ্টি আমার অপরিচিত নয়‌, সে কিছু পাইয়াছে। বলিলাম‌, ‘কি পেলে?’

ব্যোমকেশ এবার সম্পূর্ণ সচেতন হইয়া আমাকে দেখিতে পাইল‌, ঈষৎ লজ্জিতভাবে বলিল‌, ‘না না‌, কিছু না। তুমি দিব্যি ঘুমুচ্ছিলে‌, ভাবলাম এখানে এসে দূরবীনের সাহায্যে নিসর্গ-শোভা নিরীক্ষণ করি। তা দেখবার কিছু নেই। —এই নাও‌, তুমি দ্যাখে।’

গেল। আমি একটু অবাক হইলাম। ব্যোমকেশের আজ এ কী ভাব!

চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলাম। আতপ্ত বাতাসে বহিঃপ্রকৃতি ঝিম ঝিম করিতেছে। দূরবীন চোখে দিলাম; দূরবীন এদিক-ওদিক ঘুরিয়া রামকিশোরবাবুর বাড়ির উপর স্থির হইল।

দূরবীন দিয়া দেখার সহিত আড়ি পাতার একটা সাদৃশ্য আছে; এ যেন ‘চোখ দিয়া আড়ি পাতা। রামকিশোরবাবুর বাড়িটা দূরবীনের ভিতর দিয়া আমার দশ হাতের মধ্যে আসিয়া গিয়াছে; বাড়ির সবই আমি দেখিতে পাইতেছি‌, অথচ আমাকে কেহ দেখিতে পাইতেছে না।

বাড়ির সদরে কেহ নাই‌, কিন্তু দরজা খোলা। দূরবীন উপরে উঠিল। হাঁটু পর্যন্ত আলিসা-ঘেরা ছাদ‌, সিঁড়ি পিছন দিকে। রমাপতি আলিসার উপর গালে হাত দিয়া বসিয়া আছে‌, তাহার পাশের ভাগ দেখিতে পাইতেছি। ছাদে আর কেহ নাই; রমাপতি কপাল কুঁচকাইয়া কি যেন ভাবিতেছে।

রমাপতি চমকিয়া মুখ তুলিল। সিঁড়ি দিয়া তুলসী উঠিয়া আসিল‌, তাহার মুখেচোখে গোপনতার উত্তেজনা। লঘু দ্রুতপদে রিমাপতির কাছে আসিয়া সে আচলের ভিতর হইতে ডান হাত বাহির করিয়া দেখাইল। হাতে কি একটা রহিয়াছে‌, কালো রঙের পেন্সিল কিম্বা ফাউন্টেন পেন।

দূরবীনের ভিতর দিয়া দেখিতেছি‌, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইতেছি না; যেন সে-কালের নির্বাক চলচ্চিত্র। রমাপতি উত্তেজিত হইয়া কি বলিতেছে‌, হাত নাড়িতেছে। তুলসী তাহার গলা জড়াইয়া অনুনয় করিতেছে‌, কালো জিনিসটা তাহার হাতে ধরাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে।

এই সময় রঙ্গমঞ্চে আরও কয়েকটি অভিনেতার আবির্ভাব হইল। রামকিশোরবাবু সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া আসিলেন‌, তাঁহার পিছনে বংশীধর ও মুরলীধর; সর্বশেষে মণিলাল।

সকলেই ক্রুদ্ধ; রিমাপতি দাঁড়াইয়া উঠিয়া কাঠ হইয়া রহিল। বংশীধর বিকৃত মুখভঙ্গী করিয়া তুলসীকে তাড়না করিল এবং কালো জিনিসটা তাহার হাত হইতে কড়িয়া লইল। তুলসী কিছুক্ষণ সতেজ তর্ক করিল‌, তারপর কাদো-কাঁদো মুখে নামিয়া গেল। তখন রমাপতিকে ঘিরিয়া বাকি কয়জন তর্জন-গর্জন করিতে লাগিলেন‌, কেবল মণিলাল কটমটে চক্ষে চাহিয়া অধরোষ্ঠ সম্বদ্ধ করিয়া রাখিল।

বংশীধর সহসা রমাপতির গালে একটা চড় মারিল। রামকিশোর বাধা দিলেন‌, তারপর আদেশের ভঙ্গীতে সিঁড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিলেন। সকলে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।

এই বিচিত্র দৃশ্যের অর্থ কি‌, সংলাপের অভাবে তাহা নির্ধারণ করা অসম্ভব। আমি আরও দশ মিনিট অপেক্ষা করিলম‌, কিন্তু নাটকীয় ব্যাপার আর কিছু দেখিতে পাইলাম না; যাহা কিছু ঘটিল। বাড়ির মধ্যে আমার চক্ষুর অন্তরালে ঘটিল।

নামিয়া আসিয়া ব্যোমকেশকে বলিলাম। সে গভীর মনোযোগের সহিত শুনিয়া বলিল‌, ‘রামকিশোরবাবুরা তাহলে সদর থেকে ফিরে এসেছেন।–তুলসীর হাতে জিনিসটা চিনতে পারলে না?’

‘মনে হল ফাউন্টেন পেন।’

‘দেখা যাক‌, হয়তো শীগগিরই খবর পাওয়া যাবে। রমাপতি আসতে পারে।’

রমাপতি আসিল না‌, আসিল তুলসী। ঝড়ের আগে শুষ্ক পাতার মত সে যেন উড়িতে উড়িতে আসিয়া আমাদের ঘরের চৌকাঠে আটকাইয়া গেল। তাহার মূর্তি পাগলিনীর মত‌, দুই চক্ষু রাঙা টিকটক করিতেছে। সে খাটের উপর ব্যোমকেশকে উপবিষ্ট দেখিয়া ছুটিয়া আসিয়া তাহার কোলের উপর আছড়াইয়া পড়িল‌, চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল‌, ‘আমার মাস্টার মশাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে।’

‘তাড়িয়ে দিয়েছে?’ তুলসীর কান্না থামানো সহজ হইল না। যা হোক‌, ব্যোমকেশের সস্নেহ সাত্মনায় কান্না ক্রমে ফোঁপানিতে নামিল‌, তখন প্রকৃত তথ্য জানা গেল।

জামাইবাবুর দুইটি ফাউন্টেন পেন আছে; একটি তাঁহার নিজের‌, অন্যটি তিনি বিবাহের সময় যৌতুক পাইয়াছিলেন. জামাইবাবু দুইটি কলম লইয়া কি করিবেন? তাই আজ তুলসী জামাইবাবুর অনুপস্থিতিতে তাঁহার দেরাজ হইতে কলম লইয়া মাস্টার মশাইকে দিতে গিয়াছিল-মাস্টার মশায়ের একটিও কলম নাই-মাস্টার মশাই কিন্তু লইতে চান নাই‌, রাগ করিয়া কলম যথাস্থানে রাখিয়া আসিতে হুকুম দিয়াছিলেন‌, এমন সময় বাড়ির সকলে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং মাস্টার মশাইকে চোর বলিয়া ধরিল…তুলসী এত বলিল মাস্টার মশাই চুরি করেন নাই কিন্তু কেহ শুনিল না। শেষ পর্যন্ত মারধর করিয়া মাস্টার মশাইকে বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছে।

0 Shares