আমি দূরবীনের ভিতর দিয়া যে দৃশ্য দেখিয়াছিলাম তাহার সহিত তুলসীর কাহিনীর কোথাও গরমিল নাই। আমরা দুইজনে মিলিয়া তুলসীকে প্ৰবোধ দিতে লাগিলাম, মাস্টার আবার ফিরিয়া আসিবে, কোনও ভাবনা নাই; প্রয়োজন হইলে আমরা গিয়া তুলসীর বাবাকে বলিব।
দ্বারের কাছে গলা খাঁকারির শব্দ শুনিয়া চকিতে ফিরিয়া দেখি, জামাই মণিলাল দাঁড়াইয়া আছে। তুলসী তাঁহাকে দেখিয়া তীরের মত তাহার পাশ কাটাইয়া অদৃশ্য হইল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন মণিবাবু।’
মণিলাল ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল, ‘কতা পাঠিয়েছিলেন তুলসীর খোঁজ নেবার জন্যে। ও ভারি দুরন্ত, আপনাদের বেশি বিরক্ত করে না তো?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোটেই বিরক্ত করে না। ওর মাস্টারকে নাকি তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই বলতে এসেছিল।’
মণিলাল একটু অপ্ৰস্তুত হইয়া পড়িল, বলিল, ‘হ্যাঁ, রমাপতিকে কত বিদেয় করে দিলেন। আর কেউ বাড়িতে ছিলাম না, পচাৰি দিয়ে আমার দেরাজ খুলে একটা কলম চুরি করেছিল। দামী কলম—’
ব্যোমকেশ হাত বাড়াইয়া বলিল, ‘যে কলমটা আপনার বুক পকেটে রয়েছে ঐটে কি?’
‘হ্যাঁ!’ মণিলাল কলাম ব্যোমকেশের হাতে দিল। পার্কারের কলম, দামী জিনিস। ব্যোমকেশ কলম ভালবাসে, সে তাহার মাথার ক্যাপ খুলিয়া দেখিল, পিছন খুলিয়া কালি ভরিবার যন্ত্র দেখিল; তারপর কলম ফিরাইয়া দিয়া বলিল, ‘ভাল কলম। চুরি করতে হলে এই রকম কলমই চুরি করা উচিত। বাড়িতে আর কার ফাউন্টেন পেন আছে?’
মণিলাল বলিল, ‘আর কারুর নেই। বাড়িতে পড়ালেখার বিশেষ রেওয়াজ নেই। কেবল কর্তা দোয়াত কলমে লেখেন।’
‘হুঁ। তুলসী বলছে ও নিজেই আপনার দেরাজ থেকে কলম বার করেছিল–’
মণিলাল দুঃখিতভাবে বলিল, ‘তুলসী মিথ্যে কথা বলছে। রমাপতির ও দোষ বরাবরই আছে। এই সেদিন একটা ইলেকট্রিক টর্চ—’
আমি বলিতে গেলাম, ‘ইলেকট্রিক টর্চ তো—’
কিন্তু আমি কথা শেষ করিবার পূর্বে ব্যোমকেশ বলিয়া উঠিল, ইলেকট্রিক টর্চ একটা তুচ্ছ জিনিস। রমাপতি হাজার হোক বুদ্ধিমান লোক, সে কি একটা টর্চ চুরি করে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে?’
মণিলাল কিছুক্ষণ ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, ‘আপনার কথায় আমার ধোঁকা লাগছে, কি জানি যদি সে টর্চ না চুরি করে থাকে। কিন্তু আজ আমার কলমটা–। তবে কি তুলসী সত্যিই—’
আমি জোর দিয়া বলিলাম, ‘হ্যাঁ, তুলসী সত্যি কথা বলেছে। আমি-’
ব্যোমকেশ আবার মুখে থাবা দিয়া বলিল, ‘মণিলালবাবু্, আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে। আমাদের মাথা গলানো উচিত নয়। আমরা দুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছি, কি দরকার আমাদের ওসব কথায়! আপনারা যা ভাল বুঝেছেন করেছেন।’
‘তাহলেও–কারুর নামে মিথ্যে বদনাম দেওয়া ভাল নয়–’ বলিতে বলিতে মণিলাল দ্বারের দিকে পা বাড়াইল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ। আপনাদের সদরের কাজ হয়ে গেল?’
‘হ্যাঁ, সকাল সকাল কাজ হয়ে গেল। কেবল দস্তখৎ করা বাকি ছিল।’
‘যাক, এখন তাহলে নিশ্চিন্ত।’
‘আজ্ঞে হ্যা।’
মণিলাল প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ দরজায় উঁকি মারিয়া আসিয়া বলিল, ‘আর একটু হলেই দিয়েছিলে সব ফাঁসিয়ে।’
‘সে কি! কী ফাঁসিয়ে দিয়েছিলাম!’
‘প্ৰথমে তুমি বলতে যাচ্ছিলে যে হারানো টর্চ পাওয়া গেছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘তারপর বলতে যাচ্ছিলে যে দূরবীন দিয়ে ছাদের দৃশ্য দেখেছ!’
‘হ্যাঁ, তাতে কী ক্ষতি হত?’
‘মণিলালকে কোনও কথা বলা মানেই বাড়ির সকলকে বলা। গর্দভচমাবৃত যে সিংহটিকে আমরা খুঁজছি। সে জানতে পারত যে আমরা তোষাখানার সন্ধান পেয়েছি এবং দূরবীন দিয়ে ওদের ওপর অষ্টপ্রহর নজর রেখেছি। শিকার ভড়কে যেত না?’
এ কথাটা ভাবিয়া দেখি নাই।
এই সময় সীতারাম চা লইয়া আসিল। কিছুক্ষণ পরে পাণ্ডেজি আসিলেন। তিনি আমাদের জন্য অনেক তাজা খাদ্যদ্রব্য আনিয়াছেন। সীতারাম সেগুলা মোটর হইতে আনিতে গেল। আমরা চা পান করিতে করিতে সংবাদের আদান-প্ৰদান করিলম।
আমাদের সংবাদ শুনিয়া পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘জাল থেকে মাছ বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ রমাপতি গিয়েছে, কাল বংশীধর আর মুরলীধর যাবে। তাড়াতাড়ি জাল গুটিয়ে ফেলা দরকার।–হ্যাঁ, বংশীধর কলেজ হোস্টেলে যে কুকীর্তি করেছিল তার খবর পাওয়া গেছে।’
‘কি কুকীর্তি করেছিল?’
‘একটি ছেলের সঙ্গে ওর। ঝগড়া হয়, তারপর মিটমাট হয়ে যায়। বংশীধর কিন্তু মনে মনে রাগ পুষে রেখেছিল; দোলের দিন সিদ্ধির সঙ্গে ছেলেটাকে ধুতরোর বিচি খাইয়ে দিয়েছিল। ছেলেটা মরেই যেত, অতি কষ্টে বেঁচে গেল।’
ব্যোমকেশ একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, ‘হুঁ। তাহলে বিষ প্রয়োগের অভ্যাস বংশীধরের আছে।’
‘তা আছে। শুধু গোঁয়ার নয়, রাগ পুষে রাখে।’
পাঁচটা বাজিল। ব্যোমকেশ বলিল, চলুন, আজ সন্ন্যাসী ঠাকুরের সঙ্গে একটু আলাপ করে আসা যাক।।’
১৩
দেউড়ি পর্যন্ত নামিবার পর দেখিলাম বাড়ির দিকের সিঁড়ি দিয়া বংশীধর গট্রিগাঢ় করিয়া নামিয়া আসিতেছে। আমাদের দেখিতে পাইয়া তাহার সতেজ গতিভঙ্গী কেমন যেন এলোমেলো হইয়া গেল; কিন্তু সে থামিল না, যেন শহরের রাস্তা ধরিবে এমনিভাবে আমাদের পিছনে রাখিয়া আগাইয়া গেল।
ব্যোমকেশ চুপি চুপি বলিল, ‘বংশীধর সাধুবাবার কাছে যাচ্ছিল, আমাদের দেখে ভড়কে গিয়ে অন্য পথ ধরেছে।’
বংশীধর তখনও বেশি দূর যায় নাই, পাণ্ডেজি হাঁক দিলেন, ‘বংশীধর বাবু।’
বংশীধর ফিরিয়া ভ্রূ নত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আমরা কাছে গেলাম, পাণ্ডেজি কৌতুকের সুরে বলিলেন, ‘কোথায় চলেছেন হনহনিয়ে?