বংশীধর রুক্ষ সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘বেড়াতে যাচ্ছি।’
পাণ্ডেজি হাসিয়া বলিলেন, ‘এই তো শহর বেড়িয়ে এলেন। আরও বেড়াবেন?’
বংশীধরের রাগের শিরা উচু হইয়া উঠিল, সে উদ্ধতম্বরে বলিল, ‘হ্যাঁ, বেড়াবো। আপনি পুলিস হতে পারেন, কিন্তু আমার বেড়ানো রুকতে পারেন না।’
পাণ্ডেজিরও মুখ কঠিন হইল। তিনি কড়া সুরে বলিলেন, ‘হ্যাঁ, পারি। কলেজ হোস্টেলে আপনি একজনকে বিষ খাইয়েছিলেন, সে মামলার এখনও নিম্পত্তি হয়নি। ফৌজদারি মামলার তোমাদি হয় না। আপনাকে গ্রেপ্তার করতে পারি।’
ভয়ে বংশীধরের মুখ নীল হইয়া গেল। উগ্রতা এত দ্রুত আতঙ্কে পরিবর্তিত হইতে পারে চোখে না দেখিলে বিশ্বাস হয় না। সে জালাবদ্ধ পশুর ন্যায় ক্ষিপ্ৰচক্ষে এদিক ওদিক চাহিল, তারপরে যে পথে আসিয়াছিল সেই সিঁড়ি দিয়া পলকের মধ্যে বাড়ির দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
পাণ্ডেজি মৃদুকণ্ঠে হাসিলেন।
‘বংশীধরের বিক্রম বোঝা গেছে। —চলুন।’
সাধুবাবার নিকট উপস্থিত হইলাম। চারিদিকের ঝাঁকড়া গাছ স্থানটিকে প্রায় অন্ধকার করিয়া তুলিয়াছে। জ্বলন্ত ধুনির সম্মুখে বাবাজী বসিয়া আছেন। আমাদের দেখিয়া নীরব অথচ ইঙ্গিতপূর্ণ হাস্যে তাঁহার মুখ ভরিয়া উঠিল, তিনি হাতের ইশারায় আমাদের বসিতে বলিলেন।
পাণ্ডেজি তাঁহার সহিত কথা আরম্ভ করিলেন। বলা বাহুল্য, হিন্দীতেই কথাবার্তা হইল। পাণ্ডেজির গায়ে পুলিসের খাকি কামিজ ছিল, সাধুবাবা তাঁহার সহিত সমধিক আগ্রহে কথা বলিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথা হইল। সন্ন্যাস জীবনের মাহাত্ম্য এবং গাৰ্হস্থ্য জীবনের পঙ্কিলতা সম্বন্ধে আমরা সকলেই একমত হইলাম। হৃষ্ট বাবাজী বুলি হইতে গাঁজা বাহির করিয়া সাজিবার উপক্ৰম করিলেন।
পাণ্ডেজি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এখানে গাঁজা কোথায় পান। বাবা?’
বাবাজী উর্ধের্ব কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন, ‘পরমাৎমা মিলিয়ে দেন বেটা।’
চিমটা দিয়া ধুনি হইতে একখণ্ড অঙ্গার তুলিয়া বাবাজী কলিকার মাথায় রাখিলেন। এই সময়ে তাঁহার চিমটাটি ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলম। সাধুরা যে নিৰ্ভয়ে বনে-বাদাড়ে বাস করেন তাহা নিতান্ত নিরন্ত্রভাবে নয়। চিমটা ভালভাবে ব্যবহার করিতে জানিলে ইহার দ্বারা বোধ করি বাঘ মারা যায়। আবার তাহার সূচাগ্রতীক্ষা প্রান্ত দু’টির সাহায্যে ক্ষুদ্র অঙ্গর খণ্ডও যে তুলিয়া লওয়া যায় তাহা তো স্বচক্ষেই দেখিলাম। সাধুরা এই একটি মাত্র লৌহাস্ত্ৰ দিয়া নানা কাৰ্য সাধন করিয়া থাকেন।
যা হোক, বাবাজী গাঁজার কলিকায় দম দিলেন। তাঁহার গ্ৰীবা এবং রাগের শিরা-উপশিরা ফুলিয়া উঠিল। দীর্ঘ একমিনিটব্যাপী দম দিয়া বাবাজী নিঃশেষিত কলিকাটি উপুড় করিয়া দিলেন।
তারপর ধোঁয়া ছাড়িবার পালা। এ কার্যটি বাবাজী প্ৰায় তিন মিনিট ধরিয়া করিলেন; দাড়ি-গোঁফের ভিতর হইতে মন্দ মন্দ ধূম বাহির হইয়া বাতাসকে সুরভিত করিয়া তুলিল।
বাবাজী বলিলেন, ‘বম! বম শঙ্কর’
এই সময় পায়ের শব্দে পিছন ফিরিয়া দেখিলাম, একটি লোক আসিতেছে। লোকটি আমাদের দেখিতে পাইয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। তখন চিনিলাম, রামকিশোরবাবু! তিনি আমাদের চিনিতে পারিয়া স্থলিত স্বরে বলিলেন, ‘ও-আপনারা–!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আসুন।’
রামকিশোর ঈষৎ নিরাশ কষ্ঠে বলিলেন, ‘না, আপনারা সাধুজীর সঙ্গে কথা বলছেন বলুন। আমি কেবল দর্শন করতে এসেছিলাম।’ জোড়হস্তে সাধুকে প্ৰণাম করিয়া তিনি প্ৰস্থান করিলেন।
সাধুর দিকে ফিরিয়া দেখিলাম তাঁহার মুখে সেই বিচিত্ৰ হাসি। হাসিটিকে বিশ্লেষণ করিলে কতখানি আধ্যাত্মিকতা এবং কতখানি নষ্টামি পাওয়া যায় তাহা বলা শক্ত। সম্ভবত সমান সমান।
এইবার ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাধুবাবা, আপনি তো অনেকদিন এখানে আছেন। সেদিন একটি লোক এখানে সর্পাঘাতে মারা গেছে, জানেন কি?’
সাধু বলিলেন, ‘জানতা হ্যায়। হম ক্যা নাহি জনতা!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আচ্ছা, সে রাত্রে কেউ দুর্গে গিয়েছিল কি না। আপনি দেখেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, দেখা।’
বাবাজীর মুখে আবার সেই আধ্যাত্মিক নষ্টামিভরা হাসি দেখা গেল। ব্যোমকেশ সাগ্রহে আবার তাঁহাকে প্রশ্ন করিতে যাইতেছিল, আবার পিছন দিকে পায়ের শব্দ হইল। আমরা ঘাড় ফিরাইলাম, বাবাজীও প্রখর চক্ষে সেই দিকে চাহিলেন। কিন্তু আগন্তুক কেহ আসিল না; হয়তো আমাদের উপস্থিতি জানিতে পারিয়া দূর হইতেই ফিরিয়া গেল।
ব্যোমকেশ আবার বাবাজীকে প্রশ্ন করিতে উদ্যত হইলে তিনি ঠোঁটের উপর আঙুল রাখিয়া পরিষ্কার বাঙলায় বলিলেন, ‘এখন নয়। রাত বারোটার সময় এস, তখন বলব।’
আমি অবাক হইয়া চাহিলাম। ব্যোমকেশ কিন্তু চট করিয়া উঠিয়া পড়িল, বলিল, ‘আচ্ছা বাবা, তাই আসিব। ওঠ অজিত।’
বৃক্ষ-বাটিকার বাহিরে আসিয়া দেখিলাম রাত্রি হইয়া গিয়াছে। ব্যোমকেশ ও পাণ্ডেজি চারিদিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন, কিন্তু সন্দেহভাজন কাহাকেও দেখা গেল না।
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘আমি আজ এখান থেকেই ফিরি। রাত বারোটা পর্যন্ত থাকতে পারলে হত। কিন্তু উপায় নেই। কাল সকালেই আসব।’
পাণ্ডেজি চলিয়া গেলেন।
দুর্গে ফিরিতে ফিরিতে প্রশ্ন করিলম, ‘সাধুবাবা বাঙালী?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সাক্ষাৎ বাঙালী।’
দুৰ্গে ফিরিয়া ঘড়ি দেখিলাম, সাতটা বাজিয়াছে। মুক্ত আকাশের তলে চেয়ার পাতিয়া বসিলাম।
সাধুবাবা নিশ্চয় কিছু জানে। কী জানে? সে রাত্রে ঈশানবাবুর হত্যাকারীকে দুর্গে প্রবেশ করিতে দেখিয়ছিল? বৃক্ষ-বাটিকা হইতে দুর্গে উঠিবার সিঁড়ি দেখা যায় না; বিশেষত অন্ধকার রাত্রে। তবে কি সাধুবাবা গভীর রাত্রে সিঁড়ির আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়?…তাহার চিমটা কিন্তু সামান্য অস্ত্র নয়–ঐ চিমটার আগায় বিষ মাখাইয়া যদি–