ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিলম; সে কেবল গলার মধ্যে চাপা কাশির মত শব্দ করিল।
রাত্রি দশটার মধ্যে আহার সমাধা করিয়া আমরা আবার বাহিরে গিয়া বসিলাম। এখনও দুঘন্টা জাগিয়া থাকিতে হইবে। সীতারাম আহার সম্পন্ন করিয়া আড়ালে গেল; বোধ করি দু’ একটা বিড়ি টানবে। লণ্ঠনটা ঘরের কোণে কমানো আছে।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটার দিকে চলিয়াছে। মনের উত্তেজনা সত্ত্বেও ক্রমাগত হাই উঠিতেছে–
‘ব্যোমকেশবাবু!’
চাপা গলার শব্দে চমকিয়া জড়তা কাটিয়া গেল। দেখিলাম, অদূরে ছায়ার মত একটি মূর্তি দাঁড়াইয়া আছে। ব্যোমকেশ উঠিয়া বলিল, রমাপতি! এস।’
রমাপতিকে লইয়া আমরা ঘরের মধ্যে গেলাম। ব্যোমকেশ আলো বাড়াইয়া দিয়া তাহার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিল, ‘এবেলা কিছু খাওয়া হয়নি দেখছি।–সীতারাম!’
সীতারাম পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকটা ডিম ভাজিয়া আনিয়া রমাপতির সম্মুখে রাখিল। রমাপতি দ্বিরুক্তি না করিয়া খাইতে আরম্ভ করিল। তাহার মুখ শুষ্ক্্, চোখ বসিয়া গিয়াছে; গায়ের হাফ-শার্ট স্থানে স্থানে ছিঁড়িয়া গিয়াছে, পায়ে জুতা নাই। খাইতে খাইতে বলিল, ‘সব শুনেছেন তাহলে? কার কাছে শুনলেন?’
‘তুলসীর কাছে। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’
‘জঙ্গলে। তারপর দুর্গের পিছনে।’
‘বেশি মারধর করেছে নাকি?’
রমাপতি পিঠের কামিজ তুলিয়া দেখাইল, দাগড়া দাগড়া লাল দাগ ফুটিয়া আছে। ব্যোমকেশের মুখ শক্ত হইয়া উঠিল।
‘বংশীধর?’
রমাপতি ঘাড় নাড়িল।
‘শহরে চলে গেলে না কেন?’
রমাপতি উত্তর দিল না, নীরবে খাইতে লাগিল।
‘এখানে থেকে আর তোমার লাভ কি?’
রমাপতি অস্ফুট স্বরে বলিল, ‘তুলসী—’
‘তুলসীকে তুমি ভালবাসো?’
রমাপতি একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর আস্তে আস্তে বলিল, ‘ওকে সবাই যন্ত্রণা দেয়, ঘরে বন্ধ করে রাখে, কেউ ভালবাসে না। আমি না থাকলে ও মরে যাবে।’
আহার শেষ হইলে ব্যোমকেশ তাহাকে নিজের বিছানা দেখাইয়া বলিল, ‘শোও।’
রমাপতি ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলিয়া শয়ন করিল। ব্যোমকেশ দীর্ঘকাল তাহার পানে চাহিয়া থাকিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল, ‘রমাপতি, ঈশানবাবুকে কে খুন করেছে তুমি জানো?’
‘না, কে খুন করেছে জানি না। তবে খুন করেছে।’
‘হরিপ্রিয়াকে কে খুন করেছিল জানো?’
‘না, দিদি বলবার চেষ্টা করেছিল–কিন্তু বলতে পারেনি।’
‘বংশীধরের বৌ কোন পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছিল জানো?’
একটু চুপ করিয়া থাকিয়া রমাপতি-বলিল, ‘জানি না, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল। দিদি তাকে দেখতে পারত না, দিদির মনটা বড় কুচুটে ছিল। বোধ হয় মুখোশ পরে তাকে ভূতের ভয় দেখিয়েছিল–’
‘মুখোশ?
‘দিদির একটা জাপানী মুখোশ ছিল। ঐ ঘটনার পরদিন মুখোশটা জঙ্গলের কিনারায় কুড়িয়ে পেলাম; বোধ হয়। হাওয়ায় উড়ে গিয়ে পড়েছিল। আমি সেটা এনে দিদিকে দেখলাম, দিদি। আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললে।’
‘বংশীধর মুখোশের কথা জানে?’
‘আমি কিছু বলিনি।’
‘সাধুবাবাকে নিশ্চয় দেখেছি। কি মনে হয়?’
‘আমার ভক্তি হয় না। কিন্তু কর্তা খুব মান্য করেন। বাড়ি থেকে সিধে যায়।’
‘ঈশানবাবু কোনদিন সাধুবাবা সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলেছিলেন?’
‘না। দর্শন করতেও যাননি। উনি সাধু-সন্ন্যাসীর ওপর চটা ছিলেন।’
ব্যোমকেশ ঘড়ি দেখিয়া বলিল, ‘বারোটা বাজে। রমাপতি, তুমি ঘুমোও আমরা একটু চক্ষু বিস্ফোরিত করিয়া রমাপতি বলিল, ‘কোথায়?
‘বেশি দূর নয়, শীগগিরই ফিরব। এস অজিত।’
বড় টৰ্চটা লইয়া আমরা বাহির হইলাম।
রামকিশোরবাবুর বাড়ি নিষ্প্রদীপ। দেউড়ির পাশ দিয়া যাইতে যাইতে শুনিলাম বুলাকিলাল সগর্জনে নাক ডাকাইতেছে।
বৃক্ষ-বাটিকায় গাঢ় অন্ধকার, কেবল ভস্মাচ্ছাদিত ধুনি হইতে নিরুদ্ধ প্ৰভা বাহির হইতেছে। সাধুবাবা ধুনির পাশে শুইয়া আছেন; শয়নের ভঙ্গীটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।
ব্যোমকেশ তাঁহার মুখের উপর তীব্র আলো ফেলিল, বাবাজী। কিন্তু জাগিলেন না। ব্যোমকেশ তখন তাঁহার গায়ে হাত দিয়া নাড়া দিল এবং সশব্দে নিশ্বাস টানিয়া বলিল, ‘অ্যাঁ—?’
টর্চের আলো বাবাজীর সর্বাঙ্গ লেহন করিয়া পায়ের উপর স্থির হইল। দেখা গেল গোড়ালির উপরিভাগে সাপের দাঁতের দু’টি দাগ।
১৪
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক, এতদিনে রামবিনোদ সত্যি সত্যি দেহরক্ষা করলেন।’
‘রামবিনোদ!’
‘তুমি যে আকাশ থেকে পড়লে। বুঝতে পারনি? ধন্য তুমি।’
ধুনিতে ইন্ধন নিক্ষেপ করিয়া বহ্নিমান করিয়া তোলা হইয়াছে। বাবাজীর শব তাহার পাশে শক্ত হইয়া পড়িয়া আছে। আমরা দুইজনে কিছুদূরে মুখোমুখি উপু হইয়া বসিয়া সিগারেট টানিতেছি।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মনে আছে, প্রথম রামকিশোরবাবুকে দেখে চেনা-চেনা মনে হয়েছিল? আসলে তার কিছুক্ষণ আগে বাবাজীকে দেখেছিলাম। দুই ভায়ের চেহারায় সাদৃশ্য আছে; তখন ধরতে পারিনি। দ্বিতীয়বার রামকিশোরকে দেখে বুঝলাম।’
‘কিন্তু রামবিনোদ যে প্লেগে মারা গিয়েছিল?’
‘রামবিনোদের প্লেগ হয়েছিল, কিন্তু সে মরবার আগেই বাকি সকলে তাকে চড়ায় ফেলে পালিয়েছিল। চাঁদমোহনের কথা থেকে আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম। তারপর রামবিনোদ বেঁচে গেল। এ যেন কতকটা ভাওয়াল সন্ন্যাসীর মামলার মত।’
‘এতদিন কোথায় ছিল?’
‘তা জানি না। বোধ হয় প্রথমটা বৈরাগ্য এসেছিল, সাধু-সন্ন্যাসীর লে মিশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তারপর হঠাৎ রামকিশোরের সন্ধান পেয়ে এখানে এসে হাজির হয়েছিল। কিন্তু ওকথা যাক, এখন মড়া আগলাবার ব্যবস্থা করা দরকার। অজিত, আমি এখানে আছি, তুমি টর্চ নিয়ে যাও, সীতারামকে ডেকে নিয়ে এস। আর যদি পারো, বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিয়ে তাকেও ডেকে আনো। ওরা দু’জনে মড়া পাহারা দিক।’