বলিলাম, তুমি একলা এখানে থাকবে? সেটি হচ্ছে না। থাকতে হয় দু’জনে থাকিব, যেতে হয় দু’জনে যাব।’
‘ভয় হচ্ছে আমাকেও সাপে ছোব্লাবে! এ তেমন সাপ নয় হে, জাগা মানুষকে ছোব্লায় না। যা হোক, বলছি। যখন, চল দু’জনেই যাই।’
দেউড়িতে আসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘দাঁড়াও, বুলাকিলালকে জাগানো যাক।’
অনেক ঠেলাঠেলির পর বুলাকিলালের ঘুম ভাঙিল। তাহাকে বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ সাধুবাবা ভাঙি খেয়েছিলেন?’
‘জী, এক ঘটি খেয়েছিলেন।’
‘আর কে কে ভাঙি খেয়েছিল?’
‘আর বাড়ি থেকে চাকর এসে এক ঘটি নিয়ে গিয়েছিল।’
‘বেশ, এখন যাও, বাবাজীকে পাহারা দাও গিয়ে। আমি সীতারামকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
বুলাকিলাল বিমাইতে ঝিমাইতে চলিয়া গেল। মনে হইল, ঘুম ভাঙিলেও তাহার নেশার ঘোর কাটে নাই।
দুর্গে ফিরিয়া দেখিলাম সীতারাম জাগিয়া বসিয়া আছে। খবর শুনিয়া সে কেবল একবার চক্ষু বিস্ফারিত করিল, তারপর নিঃশব্দে নামিয়া গেল।
ঘরের মধ্যে রমাপতি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। তাহাকে জাগাইলাম না, বাহিরে আসিয়া বসিলাম। রাত্রি সাড়ে বারোটা।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ আর ঘুমানো চলবে না। অন্তত একজনকে জেগে থাকতে হবে। অজিত, তুমি না হয় ঘণ্টা দুই ঘুমিয়ে নাও, তারপর তোমাকে তুলে দিয়ে আমি ঘুমবো।’
উঠিতে মন সরিতেছিল না, মস্তিষ্ক উত্তেজিত হইয়াছিল। প্রশ্ন করিলম, ‘ব্যোমকেশ, বাবাজীকে মারলে কে?’
‘ঈশানবাবুকে যে মেরেছে সে।’
‘সে কে?’
‘তুমিই বল না। আন্দাজ করতে পারো না?’
এই কথাটাই মাথায় ঘুরিতেছিল। আস্তে আস্তে বলিলাম, ‘বাবাজী যদি রামবিনোদ হন তাহলে কে তাঁকে মারতে পারে? এক আছেন রামকিশোরবাবু—’
‘তিনি ভাইকে খুন করবেন?’
‘তিনি মুমূর্ষ ভাইকে ফেলে পালিয়েছিলেন। সেই ভাই ফিরে এসেছে, হয়তো সম্পত্তির বখরা দাবি করেছে—’
‘বেশ, ধরা যাক রামকিশোর ভাইকে খুন করেছেন। কিন্তু ঈশানবাবুকে খুন করলেন কেন?’
‘ঈশানবাবু রামবিনোদের প্রাণের বন্ধু ছিলেন, সন্ন্যাসীকে দেখে চিনতে পেরেছিলেন। হয়তো রামকিশোরকে শাসিয়েছিলেন, ভ্যালয় ভালয় সম্পত্তির ভাগ না দিলে সব ফাঁস করে দেবেন। সন্ন্যাসীকে রামবিনোদ বলে সনাক্ত করতে পারে দু’জন-চাঁদমোহন আর ঈশানবাবু। চাঁদমোহন মালিকের মুঠোর মধ্যে, ঈশানবাবুকে সরাতে পারলে সব গোল মিটে যায়—’
ব্যোমকেশ হঠাৎ আমার পিঠে চাপড় মারিয়া বলিল, ‘অজিত! ব্যাপার কি হে? তুমি যে ধারাবাহিক যুক্তিসঙ্গত কথা বলতে আরম্ভ করেছ! তবে কি এতদিনে সত্যিই বোধোদয় হল! কিন্তু আর নয়, শুয়ে পড় গিয়ে। ঠিক তিনটের সময় তোমাকে তুলে দেব।’
আমি গমনোদ্যত হইলে সে খাটো গলায় কতকটা নিজ মনেই বলিল, ‘রমাপতি ঘুমোচ্ছে—না মটকা মেরে পড়ে আছে?–যাক, ক্ষতি নেই, আমি জেগে আছি।’
বেলা আটটা আন্দাজ পাণ্ডেজি আসিলেন। বাবাজীর মৃত্যুসংবাদ নীচেই পাইয়াছিলেন, বাকি খবরও পাইলেন। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি লাস নিয়ে ফিরে যান। আবার আসবেন কিন্তু—আর শুনুন—’
ব্যোমকেশ তাঁহাকে একটু দূরে লইয়া গিয়া মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ কথা বলিল। পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘বেশ, আমি দশটার মধ্যেই ফিরব। রমাপতিকে ঘর থেকে বেরুতে দেবেন না।’
তিনি চলিয়া গেলেন।
সাড়ে ন’টার সময় আমি আর ব্যোমকেশ রামকিশোরবাবুর বাড়িতে গেলাম। বৈঠকখানায় তক্তপোশের উপর রামকিশোর বসিয়া ছিলেন, পাশে মণিলাল। বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের সামনে পায়চারি করিতেছিল, আমাদের দেখিয়া নিমেষের মধ্যে কোথায় অন্তর্হিত হইল। বোধ হয়। পারিবারিক মন্ত্রণা-সভা বসিয়াছিল, আমাদের আবিভাবে ছত্ৰভঙ্গ হইয়া গেল।
রামকিশোরের গাল বসিয়া গিয়াছে, চক্ষু কোটরগত। কিন্তু তিনি বাহিরে অবিচলিত আছেন। ক্ষীণ হাসিয়া বলিলেন, ‘আসুন-বসুন।’
তক্তপোশের ধারে চেয়ার টানিয়া বসিলাম। রামকিশোর একবার গলা ঝাড়া দিয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলিলেন, ‘সন্ন্যাসী ঠাকুরকেও সাপে কামড়েছে। ক্ৰমে দেখছি। এখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে উঠল। বংশী আর মুরলী দু’একদিনের মধ্যে চলে যাচ্ছে, আমরা বাকী ক’জন এখানেই থাকিব ভেবেছিলাম। কিন্তু সাপের উৎপাত যদি এভাবে বাড়তেই থাকে–’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘শীতকালে সাপের উৎপাত-আশ্চর্য!’
রামকিশোর বলিলেন, ‘তার ওপর বাড়িতে কাল রাত্রে আর এক উৎপাত। এ বাড়িতে আজ পর্যন্ত চোর ঢোকেনি–’
মণিলাল বলিল, ‘এ মামুলি চোর নয়।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কি হয়েছিল?’
রামকিশোর বলিলেন, ‘আমার শরীর খারাপ হয়ে অবধি মণিলাল রাত্রে আমার ঘরে শোয়। কাল রাত্রে আন্দাজ বারোটার সময়—। মণিলাল, তুমিই বল। আমার যখন ঘুম ভাঙল চোর তখন পালিয়েছে।’
মণিলাল বলিল, ‘আমার খুব সজাগ ঘুম। কাল গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, মনে হল দরজার বাইরে পায়ের শব্দ। এ বাড়ির নিয়ম রাত্রে কেউ দোরে খিল দিয়ে শোয় না, এমন কি সদর দরজাও ভেজানো থাকে। আমার মনে হল আমাদের ঘরের দোর কেউ সস্তপণে ঠেলে খোলবার চেষ্টা করছে। আমার খাট দরজা থেকে দূরে; আমি নিঃশব্দে উঠলাম, পা টিপে টিপে দোরের কাছে গোলাম।। ঘরে আলো থাকে না, অন্ধকারে দেখলাম দোরের কপাট আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। এই সময় আমি একটা বোকামি করে ফেললাম। আর একটু অপেক্ষা করলেই চোর ঘরে ঢুকতো, তখন তাকে ধরতে পারতাম। তা না করে আমি দরজা টেনে খুলতে গেলাম। চোর সতর্ক ছিল, সে দুড় দুড় করে পালাল।’
রামকিশোর বলিলেন, ‘এই সময় আমার ঘুম ভেঙে গেল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাকে চোর মনে করছেন সে তুলসী নয় তো? তুলসীর শুনেছি। রাত্রে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যোস আছে।’