রামকিশোরের মুখের ভাব কড়া হইল, তিনি বলিলেন, ‘না, তুলসী নয়। তাকে আমি কাল রাত্রে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিলাম।’
ব্যোমকেশ মণিলালকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘চোরকে আপনি চিনতে পারেননি?’
‘না। কিন্তু—’
‘আপনার বিশ্বাস চেনা লোক?’
‘হ্যাঁ।’
রামকিশোর বলিলেন, ‘লুকোছাপার দরকার নেই। আপনারা তো জানেন রমাপতিকে কাল আমি তাড়িয়ে দিয়েছি। মণিলালের বিশ্বাস সেই কোন মতলবে এসেছিল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ঠিক কাঁটার সময় এই ব্যাপার ঘটেছিল বলতে পারেন। কি?’
রামকিশোর বলিলেন, ‘ঠিক পৌঁনে বারোটার সময়। আমার বালিশের তলায় ঘড়ি থাকে, আমি দেখেছি।’
ব্যোমকেশ আমার পানে সঙ্কেতপূর্ণ দৃষ্টিপাত করিল, আমি মুখ টিপিয়া রহিলাম। রমাপতি যে পৌঁনে বারোটার সময় ব্যোমকেশের খাটে শুইয়া ছিল তাহা বলিলাম না।
রামকিশোর বিষন্ন গম্ভীর স্বরে বলিলেন, ‘আজ সকালে আর একটা কথা জানা গেল। রমাপতি তার জিনিসপত্র নিয়ে যায়নি, তার ঘরেই পড়ে ছিল। আজ সকালে ঘর তল্লাস করালাম। তার টিনের ভাঙা তোরঙ্গ থেকে এই জিনিসটা পাওয়া গেল।’ পকেট হইতে একটি সোনার কাঁটা বাহির করিয়া তিনি ব্যোমকেশের হাতে দিলেন।
মেয়ের যে-ধরনের লোহার দুভাঁজ কাঁটা দিয়া চুল বাঁধেন সেই ধরনের সোনার কাঁটা। আকারে একটু বড় ও স্কুল, দুই প্রাস্ত ছুচের মত তীক্ষ্ণ। সেটিকে নাড়িয়া চাড়িয়া ব্যোমকেশ সপ্রশ্নচক্ষে রামকিশোরের পানে চাহিল; তিনি বলিলেন, ‘আমার বড় মেয়ে হরিপ্রিয়ার চুলের কাঁটা। তার মৃত্যুর পর হারিয়ে গিয়েছিল।’
কাঁটা ফেরৎ দিয়া ব্যোমকেশ পূর্ণদৃষ্টিতে রামকিশোরের পানে চাহিয়া বলিল, ‘রামকিশোরবাবু্, এবার সোজাসুজি বোঝাপড়ার সময় হয়েছে।’
রামকিশোর যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, ‘বোঝাপড়া!’
‘হ্যাঁ। আপনার দাদা রামবিনোদবাবুর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।’ রামকিশোরের মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গেল। তিনি কথা বলিবার জন্য মুখ খুলিলেন, কিন্তু মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। তারপর অতিকষ্টে নিজেকে আয়ত্ত করিতে করিতে অর্ধরুদ্ধ স্বরে বলিলেন, ‘আমার দাদা–! কার কথা বলছেন। আপনি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘কার কথা বলছি তা আপনি জানেন। মিথ্যে অভিনয় করে লাভ নেই। সর্পাঘাত যে সত্যিকার সর্পাঘাত নয় তাও আমরা জানি। আপনার দাদাকে কাল রাত্রে খুন করা হয়েছে।’
মণিলাল বলিয়া উঠিল, ‘খুন করা হয়েছে!’
‘হ্যাঁ। আপনি জানেন কি, সন্ন্যাসীঠাকুর হচ্ছেন আপনার শ্বশুরের দাদা, রামবিনোদ সিংহ।’
রামকিশোর এতক্ষণে অনেকটা সামলাইয়াছেন, তিনি তীব্ৰস্বরে বলিলেন, ‘মিথ্যে কথা! আমার দাদা অনেকদিন আগে প্লেগে মারা গেছেন। এসব রোমান্টিক গল্প কোথা থেকে তৈরি করে আনলেন? সন্ন্যাসী আমার দাদা প্ৰমাণ করতে পারেন। সাক্ষী আছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘একজন সাক্ষী ছিলেন ঈশানবাবু্, তাঁকেও খুন করা হয়েছে।’
রামকিশোর এবার ক্ৰোধে ফাটিয়া পড়িলেন, ঊর্ধ্বস্বরে বলিলেন, ‘মিথ্যে কথা! মিথ্যে! এসব পুলিসের কারসাজি। যান। আপনারা আমার বাড়ি থেকে, এই দণ্ডে দুর্গ থেকে বেরিয়ে যান। আমার এলাকায় পুলিসের গুপ্তচরের জায়গা নেই।’
এই সময় বাহিরে জানালায় মুরলীধরের ভয়ার্ত মুখ দেখা গেল—’বাবা! পুলিস বাড়ি ঘেরাও করেছে।’ বলিয়াই সে অপসৃত হইল।
চমকিয়া দ্বারের দিকে ফিরিয়া দেখি পায়ের বুট হইতে মাথার হেলমেট পর্যন্ত পুলিস পোষাক-পরা পাণ্ডেজি ঘরে প্রবেশ করিতেছেন, তাঁহার পিছনে ব্যাগ হাতে ডাঃ ঘটক!
১৫
পাণ্ডে বলিলেন, ‘তল্লাসী পরোয়ানা আছে, আপনার বাড়ি খানাতল্লাস করব। ওয়ারেন্ট দেখতে চান?’
রামকিশোর ভীত পাংশুমুখে চাহিয়া রহিলেন, তারপর ভাঙা গলায় বলিলেন, ‘এর মানে?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘আপনার এলাকায় দুটো খুন হয়েছে। পুলিসের বিশ্বাস অপরাধী এবং অপরাধের প্রমাণ এই বাড়িতেই আছে। আমরা সার্চ করে দেখতে চাই।’
রামকিশোর আরও কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া ‘বেশ, যা ইচ্ছে করুন—বলিয়া তাকিয়ার উপর এলাইয়া পড়িলেন।
‘ডাক্তার!’
ডাক্তার ঘটক প্রস্তুত ছিল, দুই মিনিটের মধ্যে রামকিশোরকে ইনজেকশন দিল। তারপর নাড়ি টিপিয়া বলিল, ‘ভয় নেই।’
ইতিমধ্যে আমি জানোলা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম, বাহিরে পুলিস গিসগিস করিতেছে; সিঁড়ির মুখে অনেকগুলা কনস্টেবল দাঁড়াইয়া যাতায়াতের পথ বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
ইনস্পেক্টর দুবে ঘরে আসিয়া স্যালুট করিয়া দাঁড়াইল, ‘সকলে নিজের নিজের ঘরে আছে, বেরুতে মানা করে দিয়েছি।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘বেশ। দু’জন বে-সরকারী সাক্ষী চাই। অজিতবাবু্, ব্যোমকেশবাবু্, আপনার সাক্ষী থাকুন। পুলিস কোনও বে-আইনী কাজ করে কি না আপনারা লক্ষ্য রাখবেন।’
মণিলাল এতক্ষণ আমাদের কাছে দাঁড়াইয়া ছিল, বলিল, ‘আমিও কি নিজের ঘরে গিয়ে থাকব?’
পাণ্ডে তাহার দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘মণিলালবাবু! না চলুন, আপনার ঘরটাই আগে দেখা যাক।’
‘আসুন।’
পাণ্ডে, দুবে, ব্যোমকেশ ও আমি মণিলালের অনুসরণ করিয়া তাহার ঘরে প্রবেশ করিলম। ঘরটি বেশ বড়, একপাশে খাট, তাছাড়া আলমারি দেরাজ প্রভৃতি আসবাব আছে।
মণিলাল বলিল, ‘কি দেখবেন দেখুন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশি কিছু দেখবার নেই। আপনার দুটো ফাউন্টেন পেন আছে, সেই দুটো দেখলেই চলবে।’
মণিলালের মুখ হইতে ক্ষণকালের জন্য যেন একটা মুখোশ সরিয়া গেল। সেই যে ব্যোমকেশ বলিয়াছিল, গর্দভচমাবৃত সিংহ, মনে হইল সেই হিংস্ৰ শ্বাপদটা নিরীহ চমবিরণ ছাড়িয়া বাহির হইল; একটা ভয়ঙ্কর মুখ পালকের জন্য দেখিতে পাইলাম। তারপর মণিলাল গিয়া দেরাজ খুলিল; দেরাজ হইতে পাকারের কলমটি বাহির করিয়া দ্রুতহস্তে তাহার দুদিকের ঢাকনি খুলিয়া ফেলিল; কলামটাকে ছোরার মত মুঠিতে ধরিয়া ব্যোমকেশের পানে চোখ তুলিল। সে-চক্ষে যে কী ভীষণ হিংসা ও ক্ৰোধ ছিল তাহা বৰ্ণনা করা যায় না। মণিলাল শ্বদন্ত নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল, ‘এই যে কলম। নেবে? এস, নেবে এস।’