দুর্গরহস্য

বংশীধর আবার বাড়িতে আসিয়া বসিল। বাপকে বলিল‌, সে আর লেখাপড়া করিবে না‌, এখন হইতে জমিদারী দেখাশুনা করিবে। রামকিশোর বিরক্ত হইয়া বকাবকি করিলেন, কিন্তু ছেলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করিলেন না। বংশীধর জমিদারী তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল। নায়েব চাঁদমোহন দত্ত হাতে ধরিয়া তাহাকে কাজ শিখাইলেন।

যথাসময়ে রামকিশোর বংশীধরের বিবাহ দিলেন। কিন্তু বিবাহের কয়েক মাস পরেই বধূর অপঘাত মৃত্যু হইল। বংশীধর গৃহে ছিল না‌, জমিদারী পরিদর্শনে গিয়াছিল। একদিন সকালে বধূকে গৃহে পাওয়া গেল না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুই চুড়ার মধ্যবর্তী খাঁজের মধ্যে তাহার মৃতদেহ পাওয়া গেল! বন্ধু বোধ করি রাত্রে কোনও কারণে নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া খাদের কিনারায় গিয়াছিল‌, তারপর পা ফস্কাইয়া নীচে পড়িয়াছে। মৃত্যু রহস্যজনক। বংশীধর ফিক্লিয়া আসিয়া বধূর মৃত্যুর সংবাদে একেবারে ফাটিয়া পড়িল; উন্মত্ত ক্রোধে ভাই বোন কাহাকেও সে দোষারোপ করিতে বিরত হইল না। ইহার পর হইতে তাহার। ভীষণ প্রকৃতি যেন ভীষণতর হইয়া উঠিল।

রামকিশোরের দ্বিতীয় পুত্র মুরলীধর; বংশীধরের চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। গিরগিটির মত রোগা হাড়-বাহির করা চেহার‌, ধুতমিভরা ছুঁচালো মুখ; চোখ এমন সাংঘাতিক ট্যারা যে‌, কখন কোন দিকে তাকাইয়া আছে বুঝিতে পারা যায় না। তার উপর মেরুদণ্ডের ন্যুক্ততা শীর্ণ দেহটাকে ধনুকের মত বাঁকাইয়া দিয়াছে। মুরলীধর জন্মাবধি বিকলাঙ্গ। তাহার চরিত্রও বংশীধরের বিপরীত; সে রাগী নয়‌, মিটমিটে শয়তান। কিশোর বয়সে দুই ভায়ে একবার ঝগড়া হইয়াছিল‌, বংশী মুরলীর গালে একটি চড় মারিয়াছিল। মুরলীর গায়ে জোর নাই। সে তখন চড় হজম করিয়াছিল; কিন্তু কয়েকদিন পরে বংশী হঠাৎ এমন ভেদবমি আরম্ভ করিল যে যায়—যায় অবস্থা। এ ব্যাপারে মুরলীর যে কোনও হাত আছে তাহা ধরা গেল না; কিন্তু তদবধি বংশী আর কোনও দিন তাহার গায়ে হাত তুলিতে সাহস করে নাই। তর্জন গর্জন করিয়াই ক্ষান্ত হইয়াছে।

মুরলীধর লেখাপড়া শেখে নাই‌, তার উপর ওই চেহারা; বাপ তাহার বিবাহ দিলেন না। সে আপন মনে থাকে এবং দিবারাত্ৰ পান-সুপারি চিবায়। তাহার একটি খাস চাকর আছে‌, নাম গণপৎ। গণপৎ মুরলীধরেরই সমবয়স্ক; বেঁটে নিরেট চেহারা‌, গোল মুখ‌, চক্ষু দু’টিও গোল‌, লুযুগল অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি। তাহার মুখ দেখিয়া মনে হয় সে সর্বদাই শিশুসুলভ বিস্ময়ে আবিষ্ট হইয়া আছে। অথচ তাহার মত দুষ্ট খুব কম দেখা যায়। এমন দুষ্কর্ম নাই যাহা গণপতের অসাধ্য; নারীহরণ হইতে গৃহদাহ পর্যন্ত‌, প্রভুর আদেশ পাইলে সে সব কিছুই করিতে পারে। প্রভু-ভৃত্যের অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ। শোনা যায়‌, ইহারা দুইজনে মিলিয়া অনেক দুস্কৃতি করিয়াছে‌, কিন্তু কখনও ধরা পড়ে নাই।

রামকিশোরের তৃতীয় সন্তানটি কন্যা‌, নাম হরিপ্রিয়া। সে মুরলীধর অপেক্ষা বছর চারেকের ছোট; দেখিতে শুনিতে ভালই‌, কোনও শারীরিক বিকলতা নাই। কিন্তু তাহার চোখের দৃষ্টি যেন বিষমাখানো। মনও ঈর্ষার বিষে ভরা। হরিপ্রিয়া নিজের ভাই-বোনদের দু’চক্ষে দেখিতে পারিত না। সকলের ছিদ্রান্বেষণ‌, পান হইতে চুম খসিলে তীব্ৰ অসন্তোষ এবং তদুপযোগী বচন-বিন্যাস, এই ছিল হরিপ্রিয়ার স্বভাব। বংশীধরের বিবাহের পর যখন নববধূ ঘরে আসিল‌, তখন হরিপ্রিয়ার ঈর্ষার জ্বালা দ্বিগুণ বাড়িয়া গেল। বন্ধুটি ভােলমানুষ ও ভীরু স্বভাব; হরিপ্রিয়া পদে পদে তাহার খুঁৎ ধরিয়া তাহাকে অপদস্থ করিয়া বাক্যবাণে জর্জর করিয়া তুলিল।

তারপর অকস্মাৎ বধূর মৃত্যু হইল। এই দুর্যোগ কাটিয়া যাইবার কয়েক মাস পরে রামকিশোর কন্যার বিবাহ দিলেন। শ্বশুর-ঘর করিতে পারিবে না বুঝিয়া তিনি দেখিয়া শুনিয়া একটি গরীব ছেলের সঙ্গে তাহার বিবাহ দিলেন। ছেলেটির নাম মণিলাল; লেখাপড়ায় ভাল‌, বি. এস-সি. পাস করিয়াছে; স্বাস্থ্যবান‌, শান্ত প্রকৃতি‌, বিবাহের পর মণিলাল শ্বশুর গৃহে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইল।

হরিপ্রিয়া ও মণিলালের দাম্পত্য জীবন সুখের হইল। কিনা বাহির হইতে বোঝা গেল না। মণিলাল একেই চাপা প্রকৃতির যুবক‌, তার উপর দরিদ্র ঘরজামাই; আ-সুখের কারণ ঘটিলেও সে নীরব রহিল। হরিপ্রিয়াও নিজের স্বামীকে অন্যের কাছে লঘু করিল না। বরং তাহার ভ্রাতারা মণিলালকে লইয়া ঠাট্টা-তামাসা করিলে সে ফোঁস করিয়া উঠিত।

একটি বিষয়ে নবদম্পতির মধ্যে প্রকাশ্য ঐক্য ছিল। মণিলাল বিবাহের পর শ্বশুরের বিশেষ অনুরক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। শ্যালকদের সহিত তাহার সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত্‌্‌, কাহারও প্রতি অনুরাগ বিরাগ ছিল না; কিন্তু শ্বশুরের প্রতি যে তাহার অসীম শ্রদ্ধা-ভক্তি আছে তাহা তাহার প্রতি বাক্যে ও আচরণে প্রকাশ পাইত। হরিপ্রিয়াও পিতাকে ভালবাসিত; পিতাকে ছাড়া আর কাহাকেও বোধ হয় সে অন্তরের সহিত ভালবাসিত না। ভালবাসিবার শক্তি হরিপ্রিয়ার খুব বেশি। ছিল না।

হরিপ্রিয়ার পর দু’টি ভাই বোন; কিশোর বয়স্ক গদাধর এবং সর্বকনিষ্ঠা তুলসী। গদাধর একটু হাবলা গোছের‌, বয়সের অনুযায়ী বুদ্ধি পরিণত হয় নাই। কাছ কোঁচার ঠিক থাকে না‌, অকারণে হি হি করিয়া হাসে। লেখাপড়ায় তাহারও মন নাই; গুলতি লইয়া বনে পাখি শিকার করিয়া বেড়ানো তাহার একমাত্র কাজ।

এই কাজে ছোট বোন তুলসী তাহার নিত্য সঙ্গিনী। তুলসীর বুদ্ধি কিন্তু গদাধরের মত নয়‌, বরং বয়সের অনুপাতে একটু বেশি। ছিপছিপে শরীর‌, সুশ্ৰী পাৎলা মুখ‌, অত্যন্ত চঞ্চল প্রকৃতি। দুপুরবেলা জঙ্গলের মধ্যে পাখির বাসা বা খরগোশের গর্ত খুঁজিয়া বেড়ানো এবং সকল বিষয়ে গদাধরের অভিভাবকতা করা তাহার কাজ। বাড়িতে কে কোথায় কি করিতেছে কিছুই তুলসীর চক্ষু এড়ায় না। সে কখন কোথায় থাকে তাহাও নির্ণয় করা কাহারও সাধ্য নয়। তবু সব ভাইবোনের মধ্যে তুলসীকেই বোধ হয় অপেক্ষাকৃত সহজ ও প্রকৃতিস্থ বলা চলে।

0 Shares