আমরা জড়মূর্তির মত দাঁড়াইয়া রহিলাম। পাণ্ডে কোমর হইতে রিভলবার বাহির করিলেন।
মণিলাল হায়েনার মত হাসিল। তারপর নিজের বামহাতের কত্তিজর উপর কলমের নিব বিঁধিয়া অঙ্গুষ্ঠ দ্বারা কালিভরা পিচকারিটা টিপিয়া ধরিল।
ব্যোমকেশ রামকিশোরবাবুকে বলিল, ‘দুধ কলা খাইয়ে কালসাপ পুষেছিলেন। ভাগ্যে পুলিসের এই গুপ্তচরটা ছিল তাই বেঁচে গেলেন। কিন্তু এবার আমরা চললাম, আপনার আতিথ্যে আর আমাদের রুচি নেই। কেবল সাপের বিষের শিশিটা নিয়ে যাচ্ছি।’
রামকিশোর বিহ্বল ব্যাকুল চক্ষে চারিদিকে চাহিতে লাগিলেন। ব্যোমকেশ দ্বার পর্যন্ত গিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, ‘আর একটা কথা বলে যাই। আপনার পূর্বপুরুষেরা অনেক সোনা লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সে সোনা কোথায় আছে আমি জানি। কিন্তু যে-জিনিস আমার নয় তা আমি ছুঁতেও চাই না। আপনার পৈতৃক সম্পত্তি আপনি ভোগ করুন। —চলুন পাণ্ডেজি। এস অজিত।’
অপরাহ্নে পাণ্ডেজির বাসায় আরাম-কেন্দারায় অর্ধশয়ান হইয়া ব্যোমকেশ গল্প বলিতেছিল। শ্রোতা ছিলাম। আমি, পাণ্ডেজি এবং রমাপতি।
‘খুব সংক্ষেপে বলছি। যদি কিছু বাদ পড়ে যায়, প্রশ্ন কোরো।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘একটা কথা আগে বলে নিই। সেই যে সাদা গুড়ো পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন, কেমিস্টের রিপোর্ট এসেছে। এই দেখুন।’
রিপোর্ট পড়িয়া ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিল—’Sodium Tetra Borate—Borax, মানে সাধু সোহাগা কোন কাজে লাগে? এক তো জানি, সেনায় সোহাগা। আর কোনও কাজে লাগে কি?
পাণ্ডে বলিল, ‘ঠিক জানি না। সেকালে হয়তো ওষুধ-বিষুধ তৈরির কাজে লাগত।’
রিপোর্ট ফিরাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘যাক। এবার শোনো। মণিলাল বাইরে বেশ ভাল মানুষটি ছিল, কিন্তু তার স্বভাব রাক্ষসের মত; যেমন নিষ্ঠুর তেমনি লোভী। বিয়ের পর সে মনে মনে ঠিক করল শ্বশুরের গোটা সম্পত্তিটাই গ্ৰাস করবে। শালদের কাছ থেকে সে সদাব্যবহার পায়নি, স্ত্রীকেও ভালবাসেনি। কেবল শ্বশুরকে নরম ব্যবহালে বশ করেছিল।
‘মণিলালের প্রথম সুযোগ হল যখন একদল বেদে এসে ওখানে তাঁবু ফেলল। সে গোপনে তাদের কাছ থেকে সাপের বিষ সংগ্ৰহ করল।
‘স্ত্রীকে সে প্রথমেই কেন খুন করল। আপাতদৃষ্টিতে তা ধরা যায় না। হয়তো দুর্বল মুহুর্তে স্ত্রীর কাছে নিজের মতলব ব্যক্তি করে ফেলেছিল, কিম্বা হয়তো হরিপ্রিয়াই কলমে সাপের বিষ ভরার প্রক্রিয়া দেখে ফেলেছিল। মোট কথা, প্রথমেই হরিপ্রিয়াকে সরানো দরকার হয়েছিল। কিন্তু তাতে একটা মস্ত অসুবিধে, শ্বশুরের সঙ্গে সম্পর্কই ঘুচে যায়। মণিলাল কিন্তু শ্বশুরকে এমন বশ করেছিল যে তার বিশ্বাস ছিল রামকিশোর তার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেবেন না। তুলসীর দিকে তার নজর ছিল।
‘যা হোক, হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর পর কোনও গণ্ডগোল হল না, তুলসীর সঙ্গে কথা পাকা হয়ে রইল। মণিলাল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল, সম্পর্কটা একবার পাকা হয়ে গেলেই শালাগুলিকে একে একে সরাবে। দু’বছর কেটে গেল, তুলসী প্রায় বিয়ের যুগ্য হয়ে এসেছে, এমন সময় এলেন ঈশানবাবু; তার কিছুদিন পরে এসে জুটলেন সাধুবাবা। এঁদের দু’জনের মধ্যে অবশ্য কোনও সংযোগ ছিল না; দু’জনে শেষ পর্যন্ত জানতে পারেননি যে বন্ধুর এত কাছে আছেন।
‘রামকিশোরবাবু ভাইকে মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়েছেন এ গ্লানি তাঁর মনে ছিল। সন্ন্যাসীকে চিনতে পেরে তাঁর হৃদয়যন্ত্র খারাপ হয়ে গেল, যায়-যায় অবস্থা। একটু সামলে উঠে তিনি ভাইকে বললেন, ‘যা হবার হয়েছে, কিন্তু এখন সত্যি প্রকাশ হলে আমার বড় কলঙ্ক হবে। তুমি কোনও তীৰ্থস্থানে গিয়ে মঠ তৈরি করে থাকে, যত খরচ লাগে আমি দেব।’ রামবিনোদ। কিন্তু ভাইকে বাগে পেয়েছেন, তিনি নড়লেন না; গাছতলায় বসে ভাইকে অভিসম্পাত দিতে লাগলেন।
‘এটা আমার অনুমান। কিন্তু রামকিশোর যদি কখনও সত্যি কথা বলেন, দেখবে অনুমান মিথ্যে নয়। মণিলাল কিন্তু শ্বশুরের অসুখে বড় মুশকিলে পড়ে গেল; শ্বশুর যদি হঠাৎ পটল তোলে তার সব প্ল্যান ভেস্তে যাবে, শালারা তদণ্ডেই তাকে তাড়িয়ে দেবে। সে শ্বশুরকে মন্ত্রণা দিতে লাগল, বড় দুই ছেলেকে পৃথক করে দিতে। তাতে মণিলালের লাভ, রামকিশোর যদি হার্টফেল করে মরেও যান, নাবালকদের অভিভাবকরূপে অর্ধেক সম্পত্তি তার কিন্তুজায় আসবে। তারপর তুলসীকে সে বিয়ে করবে, আর গদাধর সর্পাঘাতে মরবে।
‘মণিলালকে রামকিশোর অগাধ বিশ্বাস করতেন, তাছাড়া তাঁর নিজেরই ভয় ছিল তাঁর মৃত্যুর পর বড় দুই ছেলে নাবালক ভাইবোনকে বঞ্চিত করবে। তিনি রাজী হলেন; উকিলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলতে লাগিল।
‘ওদিকে দুর্গে আর একটি ঘটনা ঘটছিল; ঈশানবাবু গুপ্তধনের সন্ধানে লেগেছিলেন। প্রথমে তিনি পার্টিতে খোদাই করা ফারসী লেখাটা পেলেন। লেখাটা তিনি সযত্নে খাতায় টুকে রাখলেন এবং অনুসন্ধান চালাতে লাগলেন। তারপর নিজের শোবার ঘরে গজাল নাড়তে নাড়তে দেখলেন, একটা পাথর আলগা। বুঝতে বাকি রইল না যে ঐ পাথরের তলায় দুর্গের তোষাখানা আছে।
‘কিন্তু পাথরটা জগদ্দল ভারী; ঈশানবাবু রুগ্ন বৃদ্ধ। পাথর সরিয়ে তোষাখানায় ঢুকবেন কি করে? ঈশানবাবুর মনে পাপ ছিল, অভাবে তাঁর স্বভাব নষ্ট হয়েছিল। তিনি রামকিশোরকে খবর দিলেন না, একজন সহকারী খুঁজতে লাগলেন।
‘দু’জন পূৰ্ণবয়স্ক লোক তাঁর কাছে নিত্য যাতায়াত করত, রমাপতি আর মণিলাল। ঈশানবাবু মণিলালকে বেছে নিলেন। কারণ মণিলাল ষণ্ডা বেশি। আর সে শালদের ওপর খুশি নয় তাও ঈশানবাবু বুঝেছিলেন।