ব্যোমকেশ বলিল, ‘সত্যিই আর ভয় নেই। একে তো সব বিপদ কেটে গেছে, তার ওপর ডাক্তার পেয়েছেন। ডাক্তার ঘটক যে কত ভাল ডাক্তার তা আমি জানি কিনা। কিন্তু একটা কথা বলুন। সন্ন্যাসীকে দাদা বলতে কি আপনি এখনও রাজী নন?
রামকিশোর লজ্জায় নতমুখ হইলেন।
‘ব্যোমকেশবাবু্, নিজের লজ্জাতে নিজেই মরে আছি, আপনি আর লজ্জা দেবেন না। দাদাকে হাতে পায়ে ধরেছিলাম, দাদা সংসারী হতে রাজী হননি। বলেছিলাম, আমি হরিদ্বারে মন্দির করে দিচ্ছি। সেখানে সেবায়েৎ হয়ে রাজার হালে থাকুন। দাদা শুনলেন না। শুনলে হয়তো অপঘাত মৃত্যু হত না।’ তিনি নিশ্বাস ফেলিলেন।
পাণ্ডেজি ফিরিয়া আসিলেন, ‘তাঁহার হাতে আমাদের পূর্বদৃষ্ট মোহরটি। সেটি রামকিশোরকে দিয়া বলিলেন, ‘আপনার জিনিস আপনি রাখুন।’
রামকিশোর সাগ্রহে মোহরটি লইয়া দেখিলেন, কপালে ঠেকাইয়া বলিলেন, ‘আমার পিতৃপুরুষের সম্পত্তি। তাঁরা সবই রেখে গিয়েছিলেন, আমাদের কপালের দোষে এতদিন পাইনি। ব্যোমকেশবাবু্, সত্যিই কি সন্ধান পেয়েছেন?’
‘পেয়েছি বলেই আমার বিশ্বাস। তবে চোখে দেখিনি।’
‘তাহলে—তাহলে—!’ রামকিশোরবাবু ঢোক গিলিলেন।
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিল।
‘আপনার এলাকার মধ্যেই আছে। খুঁজে নিন না।’
‘খোঁজবার কি ত্রুটি করেছি, ব্যোমকেশবাবু? কেল্লা কিনে অবধি তার আগাপাস্তলা তন্ন তন্ন করেছি। পাইনি; হতাশ হয়ে ভেবেছি সিপাহীরা লুটেপুটে নিয়ে গেছে। আপনি যদি জানেন, বলুন। আমি আপনাকে বঞ্চিত করব না, আপনিও বাখরা পাবেন। এঁদের সালিশ মানছি, পাণ্ডেজি আর ডাক্তার ঘটক যা ন্যায্য বিবেচনা করবেন তাই দেব। আপনি আমার অশেষ উপকার করেছেন, যদি অর্ধেক বাখরাও চান–’
ব্যোমকেশ নীরস স্বরে বলিল, ‘বখর চাই না। কিন্তু দুটো শর্ত আছে।’
‘শর্ত! কী শর্ত?’
‘প্রথম শর্ত, রমাপতির সঙ্গে তুলসীর বিয়ে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, বিয়ের যৌতুক হিসেবে আপনার দুর্গ রমাপতিকে লেখাপড়া করে দিতে হবে।’
ব্যোমকেশ যে ভিতরে ভিতরে ঘটকালি করিতেছে তাহা সন্দেহ করি নাই। সকলে উচ্চকিত হইয়া উঠিলাম। রমাপতি লজ্জিত মুখে সরিয়া গেল।
রামকিশোর কয়েক মিনিট হেঁট মুখে চিন্তা করিয়া মুখ তুলিলেন। বলিলেন, ‘তাই হবে। রমাপতিকে আমার অপছন্দ নয়। ওকে চিনি, ও ভাল ছেলে। অন্য কোথাও বিয়ে দিলে আবার হয়তো একটা ভূত-বাঁদর জুটবে। তার দরকার নেই।’
‘আর দুর্গ?’
‘দুর্গ লেখাপড়া করে দেব। আপনি চান পৈতৃক সোনাদানা তুলসী আর রমাপতি পাবে, এই তো? বেশ তাই হবে।’
‘কথার নড়াচড় হবে না?’
রামকিশোর একটু কড়া সুরে বলিলেন, ‘আমি রাজা জানকীরামের সন্তান। কথার নড়াচড় কখনও করিনি।’
‘বেশ। আজ তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কাল সকালে আমরা যাব।’
পরদিন প্ৰভাতে আমরা আবার দুর্গে উপস্থিত হইলাম। আমরা চারজন-আমি, ব্যোমকেশ পাণ্ডেজি ও সীতারাম। অন্য পক্ষ হইতে কেবল রামকিশোর ও রমাপতি। বুলাকিলালকে হুকুম দেওয়া হইয়াছিল দুর্গে যেন আর কেহনা আসে। সে দেউড়িতে পাহারা দিতেছিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনারা অনেক বছর ধরে খুঁজে খুঁজে যা পাননি ঈশানবাবু দুহাপ্তায় তা খুঁজে বার করেছিলেন। তার কারণ তিনি প্রত্নতত্ত্ববিৎ ছিলেন, কোথায় খুঁজতে হয় জানতেন। প্ৰথমে তিনি পেলেন একটা শিলালিপি, তাতে লেখা ছিল,–’যদি আমি বা জয়রাম বাঁচিয়া না থাকি আমাদের তামাম ধনসম্পত্তি সোনাদানা মোহনলালের জিম্মায় গচ্ছিত রহিল।’ এ লিপি রাজারামের লেখা। কিন্তু মোহনলাল কে? ঈশানবাবু বুঝতে পারলেন না। বুঝতে পারলে মনে হয় গণ্ডগোলই হত না, তিনি চুরি করবার বৃথা চেষ্টা না করে সরাসরির রামকিশোরকে খবর দিতেন।
‘তারপর ঈশানবাবু পেলেন গুপ্ত তোষাখানার সন্ধান; ভাবলেন সব সোনাদোনা সেইখানেই আছে। আমরা জানি তোষাখানায় একটি গড়িয়ে পড়া মোহর ছাড়া আর কিছুই ছিল না; বাকি সব কিছু রাজারাম সরিয়ে ফেলেছিলেন। এইখানে বলে রাখি, সিপাহীরা তোষাখানা খুঁজে পায়নি; পেলে হাঁড়িকলসীগুলো আস্ত থাকত না।
‘সে যাক। প্রশ্ন হচ্ছে, মোহনলাল কে, যার জিন্মায় রাজারাম তামাম ধনসম্পত্তি গচ্ছিত রেখে গিয়েছিলেন? একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় মোহনলাল মানুষ হতে পারে না। দুর্গে সে সময় রাজারাম আর জয়রাম ছাড়া আর কেউ ছিল না; রাজারাম সকলকে বিদেয় করে দিয়েছিলেন। তবে কার জিন্মায় সোনাদানা গচ্ছিত রাখলেন? মোহনলাল কেমন জীব?
‘আমিও প্রথমটা কিছু ধরতে পারছিলাম না। তারপর অজিত হঠাৎ একদিন পলাশীর যুদ্ধ আবৃত্তি করল—’আবার আবার সেই কামান গর্জন-গৰ্জিল মোহনলাল.’। কামান—মোহনলাল। সেকালে বড় বড় বীরের নামে কামানের নামকরণ হত। বিদ্যুতের মত মাথায় খেলে গেল মোহনলাল কে! কার জিম্মায় সোনাদানা আছে। ঐ যে মোহনলাল।’ ব্যোমকেশ অঙ্গুলি দিয়া ভূমিশয়ান কামনটি দেখাইল।
আমরা সকলেই উত্তেজিত হইয়াছিলাম; রামকিশোর অস্থির হইয়া বলিলেন, ‘অ্যাঁ! তাহলে কামানের নীচে সোনা পোঁতা আছে।’
‘কামানের নীচে নয়। সেকালে সকলেই মাটিতে সোনা পুতে রাখত; রাজারাম অমন কাঁচা কাজ করেননি। তিনি কামানের নলের মধ্যে সোনা ঢেলে দিয়ে কামানের মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঐ যে দেখছেন কামানের মুখ থেকে শুকনো ঘাসের গোছা গলা বাড়িয়ে আছে, একশো বছর আগে সিপাহীরাও অমনি শুকনো ঘাস দেখেছিল; তারা ভাবতেও পারেনি যে ভাঙা অকমণ্য কামানের পেটের মধ্যে সোনা জমাট হয়ে আছে।’
রামকিশোর অধীর কণ্ঠে বলিলেন, ‘তবে আর দেরি কেন? আসুন, মাটি খুঁড়ে মোহর বের করা যাক।’