ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোহর? মোহর কোথায়? মোহর আর নেই। রামকিশোরবাবু। রাজারাম এমন বুদ্ধি খেলিয়েছিলেন যে সিপাহীরা সন্ধান পেলেও সোনা তুলে নিয়ে যেতে পারত না।’
‘মানে-মনে-কিছু বুঝতে পারছি না।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পাণ্ডেজি, তোষাখানায় একটা উনন আর হাপর দেখেছিলেন মনে আছে? সোহাগাও একটা হাঁড়িতে ছিল। বুঝতে পারলেন? রাজারাম তাঁর সমস্ত মোহর গলিয়ে ঐ কামানের মুখে ঢেলে দিয়েছিলেন। ওর ভেতরে আছে জমাট সোনার একটা খাম।’
‘তাহলে–তাহলে–’
‘ওর মুখ থেকে মাটি খুঁড়ে সোনা দেখতে পাবেন হয়তো। কিন্তু বার করতে পারবেন না।’
‘তবে উপায়?’
‘উপায় পরে করবেন। কলকাতা থেকে আকসি-অ্যাসিটিলিন আনিয়ে কামান কাটতে হবে; তিন ইঞ্চি পুরু লোহা ছেনি বাটালি দিয়ে কাটা যাবে না। আপাতত মাটি খুঁড়ে দেখা যেতে পারে আমার অনুমান সত্যি কি না–সীতারাম।’
সীতারামের হাতে লোহার তুরপুন প্রভৃতি যন্ত্রপাতি ছিল। আদেশ পাইয়া সে ঘোড়সওয়ারের মত কামানের পিঠে চড়িয়া বসিল। আমরা নীচে কামানের মুখের কাছে সমবেত হইলাম। সীতারাম মহা উৎসাহে মাটি খুঁড়িতে লাগিল।
প্রায় এক ফুট কাটিবার পর সীতারাম বলিল, ‘হুজুর, আর কাটা যাচ্ছে না। শক্ত লাগছে!’
পাণ্ডেজি বলিলেন, ‘লোগাও তুরপুন!’
সীতারাম তখন কামানের মুখের মধ্যে তুরপুন ঢুকাইয়া পাক দিতে আরম্ভ করিল। দু’চারবার ঘুরাইবার পর চাকলা চাকলা সোনার ফালি ছিটকাইয়া বাহিরে আসিয়া পড়িতে লাগিল। আমরা সকলে উত্তেজনায় দিশাহারা হইয়া কেবল অর্থহীন চীৎকার করিতে লাগিলাম।
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘ব্যস, সীতারাম, এবার বন্ধ কর। আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। রামকিশোরবাবু্, দুর্গের মুখে মজবুত দরজা বসান, পাহারা বসান; যতদিন না। সব সোনা বেরোয় ততদিন আপনারা সপরিবারে এসে এখানে বাস করুন। এত সোনা আলগা ফেলে রাখবেন না।’
সেদিন বাসায় ফিরিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া শুনিলাম ব্যোমকেশের নামে ‘তারা’ আসিয়াছে। আমাদের মুখ শুকাইয়া গেল। হঠাৎ ‘তার কেন? কাহার ‘তার’–সত্যবতী ভাল আছে তো!
তারের খাম ছিড়িতে ব্যোমকেশের হাত একটু কাঁপিয়া গেল। আমি অদূরে দাঁড়াইয়া অপলকচক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিলাম।
‘তার’ পড়িতে পড়িতে তাহার মুখখানা কেমন এক রকম হইয়া গেল; তারপর সে মুখ তুলিল। গলা ঝাড়া দিয়া বলিল, ‘ওদিকেও সোনা।’
‘সোনা!’
‘হ্যাঁ-ছেলে হয়েছে।’
ছয় মাস পরে বৈশাখের গোড়ার দিকে কলকাতা শহরে গরম পড়ি-পড়ি করিতেছিল। একদিন সকালবেলা আমি এবং ব্যোমকেশ ভাগাভাগি করিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছি, সত্যবতী একবাটি দুধ ও ছেলে লইয়া মেঝেয় বসিয়াছে, দুধ খাওয়ানো উপলক্ষে মাতাপুত্ৰে মল্লযুদ্ধ চলিতেছিল, এমন সময় সদর দরজায় খট্খটু শব্দ হইল। সত্যবতী ছেলে লইয়া পলাইবার উপক্ৰম করিল। আমি দ্বার খুলিয়া দেখি রমাপতি ও তুলসী। রমাপতির হাতে একটি চৌকশ বাক্স, গায়ে সিঙ্কের পাঞ্জাবি, মুখে সলজ্জ হাসি।
তুলসীকে দেখিয়া আর চেনা যায় না। এই কয় মাসে সে রীতিমত একটা যুবতী হইয়া উঠিয়াছে। অগ্রহায়ণ মাসে তাহদের বিবাহ উপলক্ষে আমরা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলাম, কিন্তু যাইতে পারি নাই। ছয় মাস পরে তাহদের দেখিলাম।
তুলসী ঘরে আসিয়াই একেবারে ঝড় বহাইয়া দিল। সত্যবতীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিবার সঙ্গে সঙ্গে সে তাহার কোল থেকে খোকাকে তুলিয়া লইয়া তাহাকে চুম্বন করিতে করিতে ঘরময় ছুটাছুটি করিল; তারপর তাহাকে রমাপতির কোলে ফেলিয়া দিয়া সত্যবতীর আঁচল ধরিয়া টানিতে টানিতে পাশের ঘরে লইয়া গেল। তাহদের কলকাকলি ও হাসিয়া শব্দ পদ ভেদ করিয়া আমাদের কানে আসিতে লাগিল।
তুলসীর চরিত্ৰ যেন পাথরের তলায় চাপা ছিল, এখন মুক্তি পাইয়াছে। নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।
ঘর ঠাণ্ডা হইলে ব্যোমকেশ রমাপতিকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘বাক্স কিসের? গ্রামোফোন নাকি?’
‘না। আমরা আপনার জন্যে একটা জিনিস তৈরি করিয়ে এনেছি্,–বলিয়া রমাপতি বাক্স খুলিয়া যে জিনিসটি বাহির করিল। আমরা তাহার পানে মুগ্ধনেত্ৰে চাহিয়া রহিলাম। আগাগোড়া সোনায় গড়া দুর্গের একটি মডেল। ওজন প্রায় দুই সের, অপূর্ব কারুকার্য। আসল দুর্গের সহিত কোথাও এক তিল তফাত নাই; এমন কি কামানটি পর্যন্ত যথাস্থানে রহিয়াছে।
আমরা চমৎকৃত স্বরে বলিলাম, ‘বাঃ!’
তারপর খাওয়া-দাওয়া গল্পগাছ রঙ্গতামাসায় বেলা কাটিয়া গেল। রামকিশোরবাবুদের খবর জানা গেল, কর্তার শরীর ভালই যাইতেছে, বংশীধর নিজের জমিদারীতে বাড়ি তৈয়ারি করিয়াছে; মুরলীধর শহরে বাড়ি কিনিয়া বাস করিতেছে; গদাধর তুলসী ও রমাপতিকে লইয়া কর্তা শৈলগৃহেই আছেন; চাঁদমােহন আবার জমিদারী দেখাশুনা করিতেছেন। দুর্গটিকে সম্পূর্ণরূপে সংস্কার করানো হইতেছে। তুলসী ও রমাপতি সেখানে বাস করিবে।
অপরাহ্নে তাহারা বিদায় লইল। বিদায়কালে ব্যোমকেশ বলিল, ‘তুলসী, তোমার মাস্টার কেমন?’
মাস্টারের দিকে কপট-কুটিল কটাক্ষপাত করিয়া তুলসী বলিল, ‘বিচ্ছিরি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ। একদিন আমার কোলে বসে মাস্টারের জন্যে কেঁদেছিলে মনে আছে?’
এবার তুলসীর লজ্জা হইল। মুখে আচল চাপা দিয়া সে বলিল, ‘ধেৎ!’
(সমাপ্ত)