সকালবেলা দলবল লইয়া রামকিশোর উদ্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হইলেন। ঘন শালবনের মধ্যে একটি স্থান পরিষ্কৃত হইয়াছে; মাটির উপর শতরঞ্চি পাতা, মাথার উপর চন্দ্ৰাতপ। পাচক উনান জ্বলিতেছে, চাকর-বাকর রান্নার উদ্যোগ করিতেছে। মোটর চালক বুলাকিলাল একরাশ সিদ্ধির পাতা লইয়া হামানদিস্তায় কুটিতে বসিয়াছে, বৈকালে ভাঙের সরবৎ হইবে। আকাশে স্বণভি রৌদ্র, শালবনের ছায়ায় স্নিগ্ধ হইয়া বাতাস মৃদুমন্দ প্রবাহিত হইতেছে। কোথাও কোনও দুর্লক্ষিণের চিহ্নমাত্র নাই।
দুই বৃদ্ধ চন্দ্ৰাতপতলে বসিয়া দাবার ছক পাতিলেন; আর সকলে বনের মধ্যে এদিক ওদিক অদৃশ্য হইয়া গেল। বংশীধর বন্দুক কাঁধে ফেলিয়া এক দিকে গেল, মুরলীধর নিত্যসঙ্গী গণপৎকে লইয়া অন্য দিকে শিকার সন্ধানে গেল। দু’জনেই ভাল বন্দুক চালাইতে পারে। গদাধর ও তুলসী একসঙ্গে বাহির হইল; মাস্টার রমাপতি দূরে দূরে থাকিয়া তাহাদের অনুসরণ করিল। কারণ ঘন জঙ্গলের মধ্যে বালকবালিকাদের পথ হারানো অসম্ভব নয়। রামকিশোর বলিয়া দিয়াছিলেন, ‘ওদের চোখে চোখে রেখো।’
জামাই মণিলাল একখানা বই লইয়া আস্তানা হইতে কিছু দূরে একটা গাছের আড়ালে গিয়া বসিল। রামকিশোর তাহাকে তন্ত্র সম্বন্ধে একটি ইংরেজি বই দিয়াছিলেন, তাহাঁই সে মনোযোগের সহিত দাগ দিয়া পড়িতেছিল। তাহার শিকারের শখ নাই।
বাকি রহিল কেবল হরিপ্রিয়া। সে কিছুক্ষণ রান্নার আয়োজনের আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়াইল, একবার স্বামীর গাছতলার দিকে গেল, তারপর একাকিনী বনের মধ্যে প্ৰবেশ করিল। আজ একদিনের জন্য সকলে স্বাধীন হইয়াছে; একই বাড়িতে এতগুলো লোক একসঙ্গে থাকিয়া যেন পরম্পরের সান্নিধ্যে হাঁপাইয়া উঠিয়াছিল, তাই বনের মধ্যে ছাড়া পাইয়া একটু নিঃসঙ্গতা উপভোগ করিয়া লইতেছে।
বেলা বাড়িতে লাগিল। দুই বৃদ্ধ খেলায় মগ্ন হইয়া গিয়াছেন, জঙ্গলের অভ্যন্তর হইতে থাকিয়া থাকিয়া বন্দুকের আওয়াজ ভাসিয়া আসিতেছে, রন্ধনের সুগন্ধ বাতাস আমোদিত করিয়া তুলিয়াছে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে গিরিচুড়ার চুনকাম করা বাড়ি এবং ভাঙা দুর্গ দেখা যাইতাছে। বেশি দূর নয়, বড় জোর আধ মাইল। ভাঙা দুর্গের ছায়া মাঝের খাদ লঙ্ঘন করিয়া সাদা বাড়ির উপর পড়িয়াছে।
হঠাৎ একটা তীব্র একটানা চীৎকার অলস বনমর্মরিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিল। দাবা খেলোয়াড় দুইজন চমকিয়া চোখ তুলিলেন। গাছের তলায় মণিলাল বই ফেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দেখা গেল, তুলসী শালবনের আলোছায়ার ভিতর দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিতেছে এবং তারস্বরে চীৎকার করিতেছে।
তুলসী চাঁদোয়া পর্যন্ত পৌঁছবার পূর্বেই মণিলাল তাহাকে ধরিয়া ফেলিল, তাহার কাঁধে একটা প্রবল ঝাঁকানি দিয়া বলিল, ‘এই তুলসী! কি হয়েছে! চেঁচাচ্ছিস কেন?’
তুলসী পাগলের মত ঘোলাটে চোখ তুলিয়া ক্ষণেক চাহিয়া রহিল, তারপর আগের মতাই চীৎকার করিয়া বলিল,–‘দিদি! গাছতলায় পড়ে আছে-বোধহয় মরে গেছে! শীগগির এসো-বাবা, জেঠামশাই, শীগগির এসো।’
তুলসী যেদিক হইতে আসিয়াছিল। আবার সেই দিকে ছুটিয়া চলিল; মণিলালও তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছুটিল। দুই বৃদ্ধ আলুথালুভাবে তাঁহাদের অনুসরণ করিলেন।
প্রায়-দুইশত গজ দূরে ঘন গাছের ঝোপ; তুলসী ঝোপের কাছে আসিয়া একটা গাছের নীচে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। হরিপ্রিয়া বাসন্তী রঙের শাড়ি পরিয়া আসিয়াছিল, দেখা গেল সে ছায়াঘন গাছের তলায় পড়িয়া আছে, আর, কে একটা লোক তাহার শরীরের উপর ঝুকিয়া নিরীক্ষণ করিতেছে।
পদশব্দ শুনিয়া রমাপতি উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ ভয়ে শীর্ণ্্, সে স্থলিত স্বরে বলিল, ‘সাপ! সাপে কামড়েছে।’
মণিলাল তাহাকে ঠেলিয়া দূরে সরাইয়া দিল, তারপর দুই বাহু দ্বারা হরিপ্রিয়াকে তুলিয়া লইল। হরিপ্রিয়ার তখন জ্ঞান নাই। বাঁ পায়ের গোড়ালির উপর সাপের দাঁতের দাগ; পাশাপাশি দু’টি রক্তবর্ণ চিহ্ন।
৪
হরিপ্রিয়া বাঁচিল না, বাড়িতে লইয়া যাইতে যাইতে পথেই তাহার মৃত্যু হইল।
জঙ্গলে ইতিপূর্বে কেহ বিষধর সাপ দেখে নাই। এবারও সাপ চোখে দেখা গেল না বটে, কিন্তু সাপের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ রহিল না; এবং ইহা যে বেদেদের কাজ, তাহারাই প্ৰতিহিংসা চরিতার্থকরিবার উদ্দেশ্যে জঙ্গলে সাপ কিম্বা সাপের ডিম ছাড়িয়া দিয়া গিয়াছে, তাহাও একপ্রকার স্বতঃসিদ্ধ হইয়া পড়িল। কিন্তু বেদের দল তখন বহুদূরে চলিয়া গিয়াছে, তাহাদের সন্ধান পাওয়া গেল না।
হরিপ্রিয়ার মৃত্যুর পর কিছুদিন রামকিশোরের বাড়ির উপর অভিশাপের মত একটা থমথমে ছায়া চাপিয়া রহিল। রামকিশোর তাঁহার সকল সন্তানদের মধ্যে হরিপ্রিয়াকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালবাসিতেন; তিনি দারুণ আঘাত পাইলেন। মণিলাল অতিশয় সম্বতচরিত্র যুবক, কিন্তু সেও এই আকস্মিক বিপর্যয়ে কেমন যেন উদভ্ৰান্ত দিশহারা হইয়া গেল। অপ্রত্যাশিত ভূমিকম্পে তাহার নবগঠিত জীবনের ভিত্তি একেবারে ধবসিয়া গিয়াছিল।
আর একজন এই অনৰ্থপাতে গুরুতরভাবে অভিভূত হইয়াছিল, সে তুলসী। তুলসী যে তাহার দিদিকে খুব বেশি ভালবাসিত তা নয়, বরং দুই বোনের মধ্যে খিটিমিটি লাগিয়াই থাকিত। হরিপ্রিয়া সুযোগ পাইলেই তুলসীকে শাসন করিত, ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিত। তবু্, হরিপ্রিয়ার মৃত্যু চোখের সামনে দেখিয়া তুলসী কেমন যেন বুদ্ধিভ্রষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল। সেদিন বনের মধ্যে বেড়াইতে বেড়াইতে সে অদূরে গাছতলায় হলুদবৰ্ণ শাড়ি দেখিয়া সেই দিকে গিয়াছিল; তারপর দিদিকে ঐভাবে পড়িয়া থাকিতে দেখিয়া ভীতভাবে ডাকাডাকি করিয়াছিল। হরিপ্রিয়া কেবল একবার চোখ মেলিয়া চাহিয়াছিল, কথা বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল।