কামান ছাড়া অতীতকালের অস্থাবর বস্তু দুৰ্গমধ্যে আর কিছু নাই। প্রাকার-ঘেরা দুৰ্গভুমি আয়তনে দুই বিঘার বেশি নয়; সমস্তটাই পাথরের পার্টি দিয়া বাঁধানো। চক্রাকার প্রাকারের গায়ে ছোট ছোট কুঠুরি; বোধ হয় পূর্বকালে এগুলিতে দুৰ্গরক্ষক সিপাহীরা থাকিত। এগুলির অবস্থা ভগ্নপ্রায়; কোথাও পাথর ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, কোথাও দ্বারের সম্মুখে কাঁটাগাছ জন্মিয়াছে। এই চক্রের মাঝখানে নাভির ন্যায় দুর্গের প্রধান ভবন। নাভি ও নেমির মধ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণের অবকাশ।
গৃহটি চতুষ্কোণ এবং বাহির হইতে দেখিলে মজবুত বলিয়া মনে হয়। পাঁচ ছয়টি ছোট বড় ঘর লইয়া গৃহ; মামুলিভাবে মেরামত করা সত্ত্বেও সব ঘরগুলি বাসের উপযোগী নয়। কোনও ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরিয়াছে, কোনও ঘরের ছাদ ফুটো হইয়া আকাশ দেখা যায়। কেবল পিছন দিকের একটি ছোট ঘর ভাল অবস্থায় আছে। যদিও চুন সুরকি খসিয়া স্কুল পাথরের গাঁথুনি প্রকট হইয়া পড়িয়াছে। তবু ঘরটিকে বাসোপযোগী করিবার জন্য তাহার প্রবেশ-পথে নূতন চৌকাঠ ও কবাট লাগানো হইয়াছে।
আমরা অন্যান্য ঘরগুলি দেখিয়া এই ঘরের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। পাণ্ডে চৌকাঠের দিকে আঙ্গুল দেখাইয়া বলিলেন, ‘অধ্যাপক মহাশয়ের লাস ঐখানে পড়ে ছিল।’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকাইয়া থাকিয়া বলিল, ‘সাপে কামড়বার পর তিনি যদি চৌকাঠে মাথা ঠুকে পড়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে মাথায় চোট লাগা অসম্ভব নয়।’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘না, অসম্ভব নয়। কিন্তু সারা বাড়িটা। আপনি দেখেছেন; ভাঙ্গা বটে। কিন্তু কোথাও এমন আবর্জনা নেই। যেখানে সাপ লুকিয়ে থাকতে পারে। অধ্যাপক মহাশয় বাস করতে আসার সময় এখানে ভাল করে কার্বলিক অ্যাসিডের জল ছড়ানো হয়েছিল, তারপরও তিনি বেঁচে থাকাকালে বার দুই ছড়ানো হয়েছে—’
‘অধ্যাপক মহাশয় আসবার আগে এখানে কেউ বাস করত না?’
পাণ্ডে মুখ টিপিয়া বলিলেন, ‘কেউ কবুল করে না। কিন্তু মুরলীধর—’
‘হুঁ–বুঝেছি।’ বলিয়া ব্যোমকেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।
ঘরটি লম্বায় চওড়ায় আন্দাজ চৌদ্দ ফুট। মেঝে শান বাঁধানো। একপাশে একটি তক্তপোশ এবং একটি আরাম-কেন্দারা ছাড়া ঘরে অন্য কোনও আসবাব নাই। অধ্যাপক মহাশয়ের ব্যবহারের জন্য যে-সকল তৈজস ছিল তাহা স্থানান্তরিত হইয়াছে।
এই ঘরে একটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করিলম যাহা অন্য কোনও ঘরে নাই। তিনটি দেয়ালে মেঝে হইতে প্ৰায় এক হাত উর্ধের্ব সারি সারি লোহার গজাল ঠোকা রহিয়াছে, গজালগুলি দেয়াল হইতে দেড় হাত বাহির হইয়া আছে। সেগুলি আগে বোধ হয় শাবলের মত স্কুল ছিল, এখন মরিচা ধরিয়া যেরূপ ভঙ্গুর আকৃতি ধারণ করিয়াছে তাহাতে মনে হয় সেগুলি জানকীরামের সমসাময়িক।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘দেয়ালে গোঁজ। কেন?’
পাণ্ডে বলিলেন, ‘এ ঘরটা বোধহয় সেকালে দুর্গের দপ্তর কিম্বা খাজনাখানা ছিল। গোঁজের ওপর তক্তা পেতে দিলে বেশ তাক হয়, তাকের ওপর নানান জিনিসপত্র, বই খাতা, এমন কি টাকার সিন্দুক রাখা চলত। এখনও বিহারের অনেক সাবেক বাড়িতে এইরকম গোঁজ দেখা যায়।’
ব্যোমকেশ ঘরের মেঝে ও দেয়ালের উপর চোখ বুলাইয়া দেখিতে লাগিল। এক সময় বলিল, ‘অধ্যাপক মহাশয় নিশ্চয় বাক্স-বিছানা এনেছিলেন। সেগুলো কোথায়?’
‘সেগুলো আমাদের অর্থাৎ পুলিসের জিন্মায় আছে।’
‘বাক্সর মধ্যে কি আছে দেখেছেন?’
‘গোটাকিয়েক জামা কাপড় আর খান-তিন-চার বই খাতা। একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা তিনটে দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা পয়সা ছিল।’
‘আর তাঁর মুঠির মধ্যে যে মোহর পাওয়া গিয়েছিল সেটা?’
‘সেটাও আমাদের জিম্মায় আছে। এ মামলার একটা নিম্পত্তি হলে সব জিনিস তাঁর ওয়ারিসকে ফেরত দিতে হবে।’
ব্যোমকেশ আরও কিছুক্ষণ ঘর পরীক্ষা করিল, কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু পাওয়া গেল না। তখন সে নিশ্বাস ছাড়িয়া বলিল, ‘চলুন। এখানকার দেখা শেষ হয়েছে।’
দুর্গ প্রাঙ্গণে আসিয়া আমরা তোরণের দিকে অগ্রসর হইয়াছি, একটি ছোকরা তোরণ দিয়া প্রবেশ করিল। মাস্টার রমাপতিকে এই প্রথম দেখিলাম। ছিপছিপে গড়ন, ময়লা রঙ, চোখেমুখে বুদ্ধির ছাপ; কিন্তু সঙ্কুচিত ভাব। বয়স উনিশ-কুড়ি। তাহাকে দেখিয়া পাণ্ডে বলিলেন, ‘কি মাস্টার, কি খবর?’
রমাপতি একটু অপ্রতিভ হাসিয়া বলিল, ‘বাড়িতে ডাক্তারবাবু আর উকিলবাবু এসেছেন। তাঁদের নিয়ে কর্তার ঘরে কি সব কাজের কথা হচ্ছে। বড়রা সবাই সেখানে আছেন। কিন্তু গদাই আর তুলসীকে দেখতে পেলাম না, তাই ভাবলাম হয়তো তারা এখানে এসেছে।’
না, তাদের তো এখানে দেখিনি।’ পাণ্ডে আমাদের সহিত রমাপতির পরিচয় করাইয়া দিলেন, ‘এঁরা আমার বন্ধু, এখানে বেড়াতে এসেছেন।’
রমাপতি একদৃষ্টি ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া থাকিয়া সংহত স্বরে বলিল, ‘আপনি কি-সত্যান্বেষী ব্যোমকেশবাবু?’
ব্যোমকেশ হাসিয়া উঠিল, ‘হ্যাঁ! কিন্তু সিলেন কি করে; আমার ছবি তো কোথাও বেরোয়নি।’
রমাপতি সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল, স্থলিত স্বরে বলিল, ‘আমি-না, ছবি দেখিনি–কিন্তু দেখে মনে হল-আপনার বই পড়েছি।–কদিন ধরে মনে হচ্ছিল-আপনি যদি আসতেন তাহলে নিশ্চয় এই ব্যাপারের মীমাংসা হত—’ সে থতমত খাইয়া চুপ করিল।
ব্যোমকেশ সদয় হাসিয়া বলিল, ‘আসুন, আপনার সঙ্গে খানিক গল্প করা যাক।’
নিকটেই কামান পড়িয়ছিল, ব্যোমকেশ রুমাল দিয়া ধূলা ঝাড়িয়া তাহার উপর বসিল, পাশের স্থান নির্দেশ করিয়া বলিল, ‘বসুন।’ রমাপতি সসঙ্কোচে তাহার পাশে বসিল।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনি বললেন আমি এলে এ ব্যাপারের মীমাংসা হবে। ঈশানবাবু তো সাপের কামড়ে মারা গেছেন। এর মীমাংসা কী হবে?’