রমাপতি উত্তর দিল না, শঙ্কিত নতমুখে অঙ্গুষ্ঠ দিয়া অঙ্গুষ্ঠের নখ খুঁটিতে লাগিল। ব্যোমকেশ তাহার। আপাদমস্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিয়া লইয়া সহজ স্বরে বলিল, ‘যাক ও কথা। ঈশানবাবু যে-রাত্রে মারা যান। সে-রাত্ৰে প্ৰায় সাড়ে ন’টা পর্যন্ত আপনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন। কি কথা হচ্ছিল?’
রমাপতি এবার সতর্কভাবে উত্তর দিল, বলিল, ‘উনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি ওঁর কাছে এলে আমার সঙ্গে নানারকম গল্প করতেন। সে-রাত্রে—’
‘সে-রাত্রে কোন্ গল্প বলছিলেন?’
‘এই দুর্গের ইতিহাস বলছিলেন।’
‘দুর্গের ইতিহাস! তাই নাকি! কি ইতিহাস শুনলেন বলুন তো, আমরাও শুনি।’
আমি আর পাণ্ডে গিয়া কামানের উপর বসিলাম। রমাপতি যে গল্প শুনিয়াছিল। তাহা বলিল। রাজা জানকীরাম হইতে আরম্ভ করিয়া সিপাহী বিদ্রোহের সময় রাজারাম ও জয়রাম পর্যন্ত কাহিনী বলিয়া গেল।
শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘হুঁ, সত্যি ইতিহাস বলেই মনে হয়। কিন্তু এ ইতিহাস তো পাঠ্যপুস্তকে পাওয়া যায় না। ঈশানবাবু জানলেন কি করে?’
রমাপতি বলিল, ‘উনি সব জানতেন। কর্তার এক ভাই ছিলেন, কম বয়সে মারা যান, তাঁর নাম ছিল রামবিনোদ সিংহ, অধ্যাপক মশায় তাঁর প্রাণের বন্ধু ছিলেন। তাঁর মুখে উনি এসব কথা শুনেছিলেন; রামবিনোদবাবুর মৃত্যু পর্যন্ত বংশের সব ইতিহাস এর জানা ছিল। একটা খাতায় সব লিখে রেখেছিলেন।’
‘খাতায় লিখে রেখেছিলেন? কোথায় খাতা?’
‘এখন খাতা কোথায় তা জানি না। কিন্তু আমি দেখেছি। বোধহয় ওঁর তোরঙ্গের মধ্যে আছে।’
ব্যোমকেশ পাণ্ডের পানে তাকাইল। পাণ্ডে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘পেন্সিলে লেখা একটা খাতা আছে, কিন্তু তাতে কি লেখা আছে তা জানি না। বাংলায় লেখা।’
‘দেখতে হবে; যা হোক–’ ব্যোমকেশ রমাপতির দিকে ফিরিয়া বলিল, ‘আপনার কাছে অনেক খবর পাওয়া গেল। —আচ্ছা, পরদিন সকালে সবার আগে আপনি আবার দুর্গে এসেছিলেন কেন, বলুন তো?’
রমাপতি বলিল, ‘উনি আমাকে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন, আজ এই পর্যন্ত থাক, কাল ভোরবেলা এসো, বাকি গল্পটা বলব!’
‘বাকি গল্পটা মানে–?’
‘তা কিছু খুলে বলেননি। তবে আমার মনে হয়েছিল যে সিপাহী যুদ্ধের পর থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত এ বংশের ইতিহাস আমাকে শোনাবেন।’
‘কিন্তু কেন? আপনাকে এ ইতিহাস শোনাবার কোনও উদ্দেশ্য ছিল কি-?’
‘তা জানি না; তাঁর যখন যা মনে আসত আমাকে বলতেন, আমারও ভাল লাগত। তাই শুনতাম। মোগল-পাঠান আমলের অনেক গল্প বলতেন। একদিন বলেছিলেন, যে-বংশে একবার ভ্রাতৃহত্যার বিষ প্রবেশ করেছে সে-বংশের আর রক্ষা নেই; যতবড় বংশই হোক তার ধ্বংস অনিবাৰ্য। এই হচ্ছে ইতিহাসের সাক্ষ্য।’
আমরা পরস্পর মুখের পানে চাহিলাম। পাণ্ডের ললাট ভ্রূকুটি-বন্ধুর হইয়া উঠিল।
ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ‘সন্ধ্যে হয়ে আসছে। চলুন, এবার ওদিকে যাওয়া যাক।’
খাদের ওপারে বাড়ির আড়ালে সূর্য তখন ঢাকা পড়িয়াছে।
৬
দেউড়ি পর্যন্ত নামিয়া আসিয়া দেখিলাম, বুলাকিলাল দুইটি বৃহৎ পাত্রে ভাঙের সরবৎ। লইয়া ঢালাঢালি করিতেছে; গদাধর এবং তুলসী পরম আগ্রহভরে দাঁড়াইয়া প্রক্রিয়া দেখিতেছে।
আমাদের আগমনে গদাধর বিরাট হাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল; তুলসী সংশয়-সঙ্কুল চক্ষু আমাদের উপর স্থাপন করিয়া কোণাচে ভাবে সরিয়া গিয়া মাস্টার রমাপতির হাত চাপিয়া ধরিল। রমাপতি তিরস্কারের সুরে বলিল, ‘কোথায় ছিলে তোমরা? আমি চারিদিকে তোমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
তুলসী জবাব দিল না, অপলক দৃষ্টিতে আমাদের পানে চাহিয়া রহিল। গদাধরের গলা হইতে একটি ঘড়ঘড় হাসির শব্দ বাহির হইল। সে বলিল, ‘সাধুবাবা গাঁজা খাচ্ছিল তাই দেখছিলাম।’
রমাপতি ধমক দিয়া বলিল, ‘সাধুর কাছে যেতে তোমাদের মানা করা হয়নি?’
গদাধর বলিল, ‘কাছে তো যাইনি, দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম।’
‘আচ্ছা, হয়েছে–এবার বাড়ি চল।’ রমাপতি তাহাদের লইয়া বাড়ির দিকে চলিল। শুনিতে পাইলাম, কয়েক ধাপ উঠিবার পর তুলসী ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলিতেছে, ‘মাস্টারমশাই, ওরা সব কারা?’
বুলাকিলাল গেলাস ভরিয়া আমাদের হাতে দিল। দধি গোলমরিচ শসার বীচি এবং আরও বহুবিধ বিকাল সহযোগে প্ৰস্তুত উৎকৃষ্ট ভাঙের সরবৎ; এমন সরবৎ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ছাড়া আর কোথাও প্রস্তুত হয় না। পাণ্ডে তারিফ করিয়া বলিলেন, ‘বাঃ, চমৎকার হয়েছে। কিন্তু বুলাকিলাল, তুমি এত ভাঙ তৈরি করেছ কার জন্যে? আমরা আসব তা তো জানতে না।’
বুলাকিলাল বলিল, ‘হুজুর, আমি আছি, সাধুবাবাও এক ঘটি চড়ান–’
‘সাধুবাবার দেখছি কিছুতেই অরুচি নেই। আর—’
‘আর-গণপৎ এক ঘটি নিয়ে যায়।’
‘গণপৎ-মুরলীধরের খাস চাকর? নিজের জন্যে নিয়ে যায়, না মালিকের জন্যে?’
‘তা জানি না হুজুর।’
‘আচ্ছা বুলাকিলাল, তুমি তো এ বাড়ির পুরোনো চাকর, বাড়িতে কে কোন নেশা করে বলতে পারো?’
বুলাকিলাল একটু চুপ করিয়া বলিল, ‘বড়কর্তা সন্ধের পর আফিম খান। আর কারুর কথা জানি না ধর্মাবতার।’
বোঝা গেল, জানিলেও বুলাকিলাল বলিবে না। আমরা সরবৎ শেষ করিয়া, আর এক প্রস্থ তারিফ করিয়া বাড়ির সিঁড়ি ধরিলাম।
এদিকেও সিঁড়ির সংখ্যা সত্তর-আশি। উপরে উঠিয়া দেখা গেল, সূর্য অস্ত গিয়াছে, কিন্তু এখনও বেশ আলো আছে। বাড়ির সদরে রমাপতি উপস্থিত ছিল, সে বলিল, ‘কর্তার সঙ্গে দেখা করবেন? আসুন।’
রমাপতি আমাদের যে ঘরটিতে লইয়া গেল সেটি বাড়ির বৈঠকখানা।
টেবিল চেয়ার ছাড়াও আর একটি ফরাস-ঢাকা বড় তক্তপোশ আছে। তক্তপোশের মধ্যস্থলে রামকিশোরবাবু আসীন; তাঁহার এক পাশে নায়েব চাঁদমোহন, অপর পাশে জামাই মণিলাল। দুই ছেলে বংশীধর ও মুরলীধর তক্তপোশের দুই কোণে বসিয়াছে। ডাক্তার ঘটক এবং উকিল হিমাংশুবাবু তক্তপোশের কিনারায় চেয়ার টানিয়া উপবিষ্ট আছেন। পশ্চিম দিকের খোলা জানালা দিয়া ঘরে আলো আসিতেছে; তবু ঘরের ভিতরটা ঘোর ঘোর হইয়া আসিয়াছে।