দুষ্টচক্র

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘আমি ডাক্তার রক্ষিত। দোর খুলুন।’

দরজা একটু ফাঁক হইল। একটি প্রৌঢ় সধবা মহিলার শীর্ণ মুখ ও আতঙ্কভরা চক্ষু দেখিতে পাইলাম। তিনি একে একে আমাদের তিনজনের মুখ দেখিয়া বোধহয় আশ্বস্ত হইলেন‌, দ্বার পুরাপুরি খুলিয়া গেল। আমরা একটি ছায়োচ্ছন্ন ঘরে প্রবেশ করিলাম।

পুরুষ কণ্ঠে শব্দ হইল‌, ‘আলোটা জেলে দাও গিন্নি।’

মহিলাটি সুইচ টিপিয়া আলো জ্বলিয়া দিলেন‌, তারপর মাথায় আচল টানিয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন।

এইবার ঘরটি স্পষ্টভাবে দেখিলাম। মধ্যমাকৃতি ঘর‌, মাঝখানে একটি খাট। খাটের উপর প্ৰেতাকৃতি একটি মানুষ গায়ে বাল্যাপোশ জড়াইয়া শুইয়া আছে। খাটের পাশে একটি ছোট টেবিলের উপর ওষুধের শিশি জলের গেলাস প্রভৃতি রাখা আছে। ঘরে অন্যান্য আসবাব যাহা আছে তাহা দেখিয়া নাসিং হোমে রোগীর কক্ষ স্মরণ হইয়া যায়।

প্রেত্যকৃতি লোকটি অবশ্য বিশু পাল। জীৰ্ণগলিত মুখে নিষ্প্রভ দু’টি চক্ষু মেলিয়া তিনি আমাদের পানে চাহিয়া আছেন। মাথার চুল পাশুটে সাদা‌, সম্মুখের দাঁতের অভাবে অধরোষ্ঠ অন্তঃপ্রবিষ্ট হইয়াছে। বয়স পঞ্চাশ কিম্বা ষাট কিম্বা সত্তর পর্যন্ত হইতে পারে। তিনি স্খলিত স্বরে বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু এসেছেন? আমার কী সৌভাগ্য। আসতে আজ্ঞা হোক।’

আমরা খাটের কাছে গিয়া দাঁড়াইলাম। বিশু পাল কম্পিত হস্ত জোড় করিয়া বলিলেন‌, ‘আপনাদের বড় কষ্ট দিয়েছি। আমারই যাওয়া উচিত ছিল‌, কিন্তু দেখছেন তো আমার অবস্থা—’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘আপনি বেশি কথা বলবেন না।’

বিশু পাল কাতর কণ্ঠে বলিলেন‌, ‘বেশি কথা না বললে চলবে কি করে ডাক্তার? ব্যোমকেশবাবুকে সব কথা বলতে হবে না?’

‘তবে যা বলবেন চটপট বলে নিন।’ ডাক্তার টেবিল হইতে একটি শিশি লইয়া খানিকটা তরল ঔষধ গেলাসে ঢালিলেন‌, তাহাতে একটু জল মিশাইয়া বিশু পালের দিকে বাড়াইয়া দিলেন‌, বলিলেন‌, ‘এই নিন‌, এটা আগে খেয়ে ফেলুন।’

বিশু পাল রুগ্ন বিরক্তিভরা মুখে ঔষধ গলাধঃকরণ করিলেন।

অতঃপর অপেক্ষাকৃত সহজ স্বরে তিনি বলিলেন‌, ‘ডাক্তার‌, এঁদের বসবার চেয়ার দাও।’

ডাক্তার দু’টি চেয়ার খাটের পাশে টানিয়া আনিলেন‌, আমরা বসিলাম। বিশু পাল ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া বলিতে আরম্ভ করিলেন‌, ‘বেশি কথা বলব না‌, ডাক্তার রাগ করবে। সাঁটে বলছি। আমার তেজারিতি কারবার আছে‌, নিশ্চয় শুনেছেন। প্ৰায় পাঁচিশ বছরের কারবার‌, বিশ লক্ষ টাকা খাটছে। অনেক বড় বড় খাতক আছে।

‘আমি কখনো জামিন জামানত না রেখে টাকা ধার দিই না। কিন্তু বছর দুই আগে আমার দুবুদ্ধি হয়েছিল‌, তার ফল এখন ভুগছি। বিনা জামিনে ত্ৰিশ হাজার টাকা ধার দিয়েছিলাম।

‘অভয় ঘোষালকে আপনি চেনেন না। আমি তার ব্যাপকে চিনতাম‌, মহাশয় ব্যক্তি ছিলেন অধর ঘোষাল। অনেক বিষয়-সম্পত্তি করেছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁর কিছু কাজ-কারবারও হয়েছিল। তাই তাঁকে চিনতাম; সত্যিকার সজ্জন।

বিছর দশেক আগে অধর ঘোষাল মারা গেলেন‌, তাঁর একমাত্র ছেলে অভয় ঘোষাল বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়ে বসল।

‘অভয়কে আমি তখনো দেখিনি। বাপ মারা যাবার পর তার সম্বন্ধে দু-একটা গল্পগুজব কানে আসত। ভাবতাম পৈতৃক সম্পত্তি হাতে পেলে সব ছেলেই গোড়ায় একটু উদ্ধৃঙ্খলতা করে‌, কালে শুধরে যাবে। এমন তো কতাই দেখা যায়।

‘আজ থেকে বছর দুই আগের ব্যাপার। অভয় ঘোষালের কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছি‌, হঠাৎ একদিন সে এসে উপস্থিত। তাকে দেখে‌, তার কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কার্তিকের মত চেহারা‌, মুখে মধু ঝরে পড়ছে। নিজের পরিচয় দিয়ে বলল‌, তার বাবা আমার বন্ধু ছিলেন‌, তাই সে বিপদে পড়ে আগে আমার কাছেই এসেছে। বড় বিপদ তার‌, শক্রিরা তাকে মিথ্যে খুনের মামলায় ফাঁসিয়েছে। কোনো মতে জামিন পেয়ে সে আমার কাছে ছুটে এসেছে‌, মামলা চালাবার জন্যে তার ত্ৰিশ হাজার টাকা চাই।

‘বললে বিশ্বাস করবেন না‌, আমি বিশু পাল বিনা জামানতে শুধু হ্যান্ডনেট লিখিয়ে নিয়ে তাকে ত্ৰিশ হাজার টাকা দিলাম। ছোঁড়া আমাকে গুণ করেছিল‌, মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল।

‘যথাসময়ে আদালতে খুনের মামলা আরম্ভ হল। খবরের কাগজে বয়ান বেরুতে লাগল; সে এক মহাভারত। এমন দুষ্কর্ম নেই যা। অভয় ঘোষাল করেনি‌, পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি প্রায় সবই উড়িয়ে দিয়েছে। কত মেয়ের সর্বনাশ করেছে তার হিসেব নেই। একটি বিবাহিতা যুবতীকে ফুসলে নিয়ে এসেছিল‌, তারপর বছরখানেক পরে তাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছে। তাইতে মোকদ্দমা। আমি একদিন এজলাসে দেখতে গিয়েছিলাম; কাঠগড়ায় অভয় ঘোষাল বসে আছে‌, যেন কোণ-ঠাসা বন-বেরাল! দেখলেই ভয় করে। ও বাবা‌, এ কাকে টাকা ধার দিয়েছি!

‘কিন্তু মোকদ্দমা টিকলো না‌, আইনের ফাঁকিতে অভয় ঘোষাল রেহাই পেয়ে গেল। একেবারে বেকসুর খালাস। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণ হল না।

‘তারপর আরো বছরখানেক কেটে গেল। আমি অভয় ঘোষালের ওপর নজর রেখেছিলাম‌, খবর পেলাম সে তার বসত-বাড়ি বিক্রি করবার চেষ্টা করছে। এইটে তার শেষ স্থাবর সম্পত্তি্‌্‌, এটা যদি সে বিক্রি করে দেয়‌, তাহলে তাকে ধরবার আর কিছু থাকবে না‌, আমার টাকা মারা যাবে।

‘টাকার তাগাদা আরম্ভ করলাম। প্রথমে অফিস থেকে চিঠি দিলাম‌, কোন জবাব নেই! বার তিনেক চিঠি দিয়েও যখন সাড়া পেলাম না‌, তখন আমি নিজেই একদিন তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। আমরা মহাজনেরা দরকার হলে বেশ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে পারি‌, ভাবলাম মামলা রুজু করবার আগে তাকে কথা শুনিয়ে আসি‌, তাতে যদি কাজ হয়। সে আজ তিন মাস আগেকার কথা।

0 Shares