দুষ্টচক্র

‘একটা গুর্খাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম তার বাড়িতে। সামনের ঘরে একটা চেয়ারে অভয় ঘোষাল একলা বসে ছিল। আমাকে দেখে সে চেয়ার থেকে উঠল না‌, কথা কইল না‌, কেবল আমার মুখের পানে চেয়ে রইল।

‘কাজের সময় কাজী কাজ ফুরোলে পাজি। গালাগালি দিতে এসেছিলাম‌, তার ওপর রাগ হয়ে গেল। আমি প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে তার চৌদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করলাম। তারপর হঠাৎ নজর পড়ল তার চোখের ওপর; ওরে বাবা‌, সে কী ভয়ঙ্কর চোেখ। লোকটা কথা কইছে না‌, কিন্তু তার চোখ দেখে বোঝা যায় যে সে আমাকে খুন করবে। যে-লোক একবার খুন করে বেঁচে গেছে‌, তার তো আশকার বেড়ে গেছে। ভয়ে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।

‘আর সেখানে দাঁড়ালাম না‌, ঊর্ধ্বশ্বাসে বাড়ি ফিরে এলাম। বাড়ি ফিরে সবঙ্গে কাঁপুনি ধরল‌, কিছুঁতেই কাঁপুনি থামে না। তখন ডাক্তারকে ডেকে পাঠালাম। ডাক্তার এসে কোনো মতে ওষুধ দিয়ে কাঁপুনি থামালো। তখনকার মত সামলে গেলাম বটে‌, কিন্তু শেষ রাত্রির দিকে আবার কাঁপুনি শুরু হল। তখন বড় ডাক্তার ডাকানো হল; তিনি এসে দেখলেন স্ট্রোক হয়েছে‌, দুটো পা অসাড়া হয়ে গেছে।

‘তারপর থেকে বিছানায় পড়ে আছি। কিন্তু প্ৰাণে শান্তি নেই। ডাক্তারেরা ভরসা দিয়েছেন রোগে মরব না‌, তবু মৃত্যুভয় যাচ্ছে না। অভয় ঘোষাল আমাকে ছাড়বে না। আমি বাড়ি থেকে বেরুই না‌, দোরের সামনে গুখ বসিয়েছি‌, তবু ভরসা পাচ্ছি না।–এখন বলুন ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার কি উপায় হবে।’

ব্বিরণ শেষ করিয়া বিশু পাল অর্ধমৃত অবস্থায় বিছানায় পড়িয়া রহিলেন। ডাক্তার একবার তাঁহার কজি টিপিয়া নাড়ি দেখিলেন‌, কিন্তু ঔষধ দিবার প্রয়োজন বোধ করিলেন না। ব্যোমকেশ গভীর ভ্রূকুটি করিয়া নতমুখে বসিয়া রহিল।

এই সময় বিশু পালের স্ত্রী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মাথায় আধ-ঘোমটা‌, দুই হাতে দু-পেয়ালা চা। আমরা উঠিয়া দাঁড়াইলাম‌, তিনি আমাদের হাতে চায়ের পেয়ালা দিয়া স্বামীর প্রতি ব্যগ্র উৎকণ্ঠার দৃষ্টি হানিয়া প্রস্থান করিলেন। নীরব প্রকৃতির মহিলা‌, কথাবার্তা বলেন না।

আমরা আবার বসিলাম। দেখিলাম বিশু পাল সপ্রশ্ন নেত্ৰে বোমকেশের মুখের পানে চাহিয়া আছেন।

ব্যোমকেশ চায়ের পেয়ালায় ক্ষুদ্র একটি চুমুক দিয়া বলিল‌, ‘আপনি যথাসাধ্য সাবধান হয়েছেন‌, আর কি করবার আছে। খাবারের ব্যবস্থা কি রকম?

বিশু পাল বলিলেন‌, ‘একটা বামুন ছিল তাকে বিদেয় করে দিয়েছি। গিন্নি রাঁধেন। বাজার থেকে কোনো খাবার আসে না।’

‘চাকর-বাকর?’

‘একটা ঝি আর একটা চাকর ছিল‌, তাদের তাড়িয়েছি। সিঁড়ির মুখে গুখ বসিয়েছি। আর কি করব বলুন।’

‘ব্যবসার কাজকর্ম চলছে কি করে?’

‘সেরেস্তাদার কাজ চালায়। নেহাৎ দরকার হলে ওপরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে যায়। কিন্তু তাকেও ঘরে ঢুকতে দিই না‌, দোরের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলে যায়। বাইরের লোক ঘরে আসে কেবল ডাক্তার।’

চায়ের পেয়ালা নিঃশেষ করিয়া ব্যোমকেশ উঠিয়া দাঁড়াইল‌, হাসিয়া বলিল‌, ‘যা-যা করা দরকার সবই আপনি করেছেন‌, আর কী করা যেতে পারে ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু সত্যিই কি অভয় ঘোষাল আপনাকে খুন করতে চায়?’

বিশু পাল উত্তেজিতভাবে উঠিয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া আবার শুইয়া পড়িলেন‌, ব্যাকুল স্বরে বলিলেন‌, ‘হ্যাঁ ব্যোমকেশবাবু্‌, আমার অন্তরাত্মা বুঝেছে ও আমাকে খুন করতে চায়। নইলে এত ভয় পাব কেন বলুন! কলকাতা শহর তো মগের মুল্লুক নয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তা বটে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’

বিশু পাল বলিলেন‌, ‘সেই তো ভাবনা‌, এভাবে কতদিন চলবে। তাই তো আপনার শরণ নিয়েছি‌, ব্যোমকেশবাবু। আপনি একটা ব্যবস্থা করুন।’

কামকেশ বলিল‌, ‘ভেবে দেখব। যদি কিছু মনে আসে‌, আপনাকে জানাব। —আচ্ছা‌, চলি।

বিশু পাল বলিলেন‌, ‘ডাক্তার!’

ডাক্তার রক্ষিত অমনি পকেট হইতে একটি একশো টাকার নোট বাহির করিয়া ব্যোমকেশের সম্মুখে ধরিলেন। ব্যোমকেশ সবিস্ময়ে ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘এটা কি?’

বিশু পাল বিছানা হইতে বলিলেন‌, ‘আপনার মর্যাদা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি‌, অনেক সময় নষ্ট করেছি।’

‘কিন্তু এ রকম তো কোনো কথা ছিল না।’

‘তা হোক। আপনাকে নিতে হবে।’

অনিচ্ছাভরে ব্যোমকেশ টাকা লইল। তারপর ডাক্তার আমাদের নীচে লইয়া চলিলেন।

সিঁড়ির মুখে গুখ স্যালুট করিল। সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এই লোকটা সারাক্ষণ পাহারা দেয়?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘না‌, ওরা দু’জন আছে। পুরোনো লোক‌, আগে দোতলায় পাহারা দিত। একজন বেলা দশটা থেকে রাত্রি আটটা পর্যন্ত থাকে‌, দ্বিতীয় ব্যক্তি রাত্রি দশটা থেকে বেলা আটটা পর্যন্ত পাহারা দেয়।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সকালে দু-ঘণ্টা এবং রাত্রে দু-ঘণ্টা পাহারা থাকে না?’

ডাক্তার বলিলেন‌, ‘না‌, সে-সময় আমি থাকি।’

দ্বিতলে নামিয়া দেখিলাম দপ্তর বন্ধ হইয়া গিয়াছে কেরানির দ্বারে তালা লাগাইয়া বাড়ি গিয়াছে।

নীচের তলায় নামিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আপনাকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই‌, ডাক্তারবাবু।’

‘বেশ তো‌, আসুন আমার ডিসপেন্সারিতে।’

আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি রোগীদের ওয়েটিং রুম‌, নূতন টেবিল চেয়ার বেঞ্চি ইত্যাদিতে সাজানো গোছানো। কম্পাউন্ডার পাশের দিকের একটি বেঞ্চিতে এক হাঁটু তুলিয়া বসিয়া ঢুলিতেছিল‌, আমাদের দেখিয়া পাশের ঘরে উঠিয়া গেল। ব্যোমকেশ ঘরের চারদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া বলিল, ‘খাসা ডাক্তারখানা সাজিয়েছেন।’

ডাক্তার শুষ্ক স্বরে বলিলেন‌, ‘সাজিয়ে রাখতে হয়; জানেন তো‌, ভেক না হলে ভিখ‌ মেলে না।’

0 Shares